অতিথি
অফিস শেষে রাঙ্গামাটি থেকে চট্টগ্রাম ফিরতে প্রায়ই বিকেল গড়িয়ে যায় সুজনের। সাপ্তাহিক ছুটির দিন ছাড়া মোটামুটি রেগুলার রুটিন। তবে আজ ব্যতিক্রম ঘটেছে। রওনা করতেই রাত আটটা পেরিয়ে গেছে। অফিসে বিশেষ একজন অতিথি এসেছিল। দুপুরে। একসাথে লাঞ্চ, চা, ঘণ্টাখানেক পরে কফি। বিকেলে গরম গরম পিঁয়াজু, চা। ঘণ্টাখানেক পরে আবার কফি। সুজনের মনে হচ্ছিল টানা এক সপ্তাহ কথা বললেও তার গল্প শেষ হবে না। এমন অতিথি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। যেমন সুন্দর দেখতে, তেমন সুন্দর কথা। ঠোঁটের কোণে হাসি লেগেই থাকে। সেই সৌন্দর্য, কথা আর হাসির চিপায় পড়ে সুজনের রুটিনে ছেদ পড়ে। পাঁচটার অফিস শেষ হয় সাড়ে সাতটায়। বাসা থেকে বউ বেশ কয়েকবার ফোন করেছিল। সুজন প্রথমদিকে কল কেটে দিয়ে মেসেজ পাঠিয়েছিল ‘In a meeting. Calling you later.’
রাত সাতটায় যখন শেষবার কল এসেছিল, তখন সুজন অতিথির দিকে মিষ্টি হেসে বলেছিল, ‘Just a minute.’ তারপর পাশের রুমে গিয়ে চাপাস্বরে কিন্তু বেশ উত্তেজিতভাবেই বলেছিল, ‘বারবার কল দিচ্ছ কেন? আমি একটা জরুরি মিটিং-এ আছি। মিটিং শেষ হলেই রওনা করব। আর কল দেওয়ার প্রয়োজন নাই।’
ওপাশ থেকে বউয়ের গলা ভেসে এল, ‘বেশি রাত হলে আসার দরকার নাই। পাহাড়িয়া রাস্তা। রাতে গাড়ি চালানো বেশ রিস্কি।”
‘অলুক্ষণে কথা বলো না। যত রাতই হোক, আমি আজই চট্টগ্রাম ফিরব।’
‘আমি তো বললাম, রাতটা ওখানেই থাকো আজ।’
‘আমাকে তুমি এতই বোকা পেয়েছ! আমি এখানে এক রাত কাটাই, আর তুমি সেই রাতের কথা তুলে আমাকে দিনের পর দিন কথা শোনাতে থাক!’
‘চোরের মন পুলিশ পুলিশ!’
‘কী বললে?’
‘বলেছি, তুমি খুব ভালো আর বিশ্বাসী স্বামী আমার!’
‘শোনো, কোনো ভালো মানুষকে যদি তুমি চোর বলতে থাক, তবে সে একদিন হঠাৎ করেই চুরি করে বসবে।’
‘আমার কাছে তোমার আর নীতিবান সাজতে হবে না। আমি তোমাকে বেশ ভালো করেই চিনি। তুমি তোমার জরুরি মিটিং শেষ করো।’
‘অফিসের কাউকে যেনো আবার কল দিয়ে বসো না। মানে, আমার খবর নিতে।’
‘ভয় নেই। দেবো না। অবশ্য একটা গোপন কথা তোমাকে বলে রাখি, আমার কল দিতে হয় না। ওরাই আমাকে কল দিয়ে জানিয়ে দেয়।’
‘আজকের মিটিং-এর ব্যাপারে কেউ কিছু বলেছে নাকি?’
‘বাসায় ফিরে আসো। তারপর কথা হবে।’ বলেই ফোন কেটে দিয়েছিল বউ।
সুজন চিন্তিত চেহারা নিয়ে তার অতিথির সামনে যেতেই সেই মিষ্টি কণ্ঠ ভেসে এল, ‘Anything serious? You look tensed!’
সুজন স্বাভাবিক হওয়ার চেষ্টা করে বলল, ‘It’s okay! Nothing special!’
‘অনেক রাত হয়ে গেল আপনার!’
ঐ কণ্ঠে ‘রাত’ শব্দটা সুজনের মনে ঝড় তুলল। বাংলা কী মাস এটা? এটা কী ঝড়-বৃষ্টির মাস? আসুক না ঝড়! মুষলধারে বৃষ্টি। ঝড়বৃষ্টিতে রাঙ্গামাটি আজ যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাক। মোবাইল নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে যাক। শুধু পাশে থাক তার অতিথি। গল্প করেই কাটিয়ে দেবে সারারাত!
‘অনেক রাত হয়ে গেল আপনার! আমি আজ উঠি! আমার বিষয়টা একটু ভালোভাবে দেখবেন।’
‘আরে না! কী যে বলেন! আমার কোনো সমস্যা নাই। আপনাদের সেবা করার জন্যই তো আমরা! যেকোনো প্রয়োজনে চলে আসবেন। যেকোনো সময়। আর হ্যাঁ, আপত্তি না থাকলে একদিন বোটে করে ঘুরতে যাব। এখানে একটা সুন্দর, নিরিবিলি জায়গা আছে। পুরো সবুজে মোড়া একটা ডাকবাংলো। আপনার ভালো লাগবে।’
‘আমি সাঁতার জানি না।’
‘আমি তো আছি। আমি পাশে থাকতে আপনার ভয় কী!’
অতিথি চোখ তুলে কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকল সুজনের চোখের দিকে। আতশি কাচের নিচে সুজনের মনটা ফেলে রেখে ভালো করে পড়ে নিয়ে একটু হেসে অতিথি বলল, ‘এমন ভরসা করার মানুষ কী আর সবসময় মেলে! যাব একদিন আপনার সাথে। ডাকবাংলো কি সবসময় সবুজে মোড়া থাকে? কুয়াশায় ঢাকা পড়ে সাদা হয়ে যায় না কখনও? আমার পরনের সাদা শাড়ির মতো!’ অতিথির গলা একটু ভারী হয়ে আসে।
সুজন কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল। অতিথির হাসি শুনে থেমে গেল, ‘মজা করছিলাম! আপনি বোট চালাতে পারেন?’
‘হ্যাঁ, পারি। আর বোটে শুধু আমরা দুজনই থাকব। বোট চালানোর জন্য আর কেউ থাকবে না।’
‘তাহলে আরো বেশি মজা হবে।’
টেবিলের ওপরে থাকা সুজনের হাতের আঙুলগুলো তখন কাঁপতে শুরু করেছে। ভেতরে রক্ত টগবগ করছে। আবেগ আড়াল করতে হাত টেবিলের নিচে নামিয়ে নিল সুজন।
‘আমি আসি আজ। আমার কাজটা যাতে দ্রুত হয়, একটু খেয়াল রাখবেন। কবে বোটট্রিপ-এ যাব, তা আমি আপনাকে জানাব।’
সুজন অতিথিকে বিদায় দিতে অফিস থেকে একদম বাইরে চলে এল। বাইরে একটা চেয়ারে বসে দারোয়ান ঝিমুচ্ছে। অতিথি চলে যাওয়ার পর সে দারোয়ানের পাশে আবার দাঁড়াল। তখনও ঝিমুচ্ছে। সুজন একটু গলাখাকারি দিতেই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল সে।
‘তোমার কাছে মোবাইল ফোন আছে?’
‘জি না, স্যার।’
‘ভালো। অফিস আওয়ারে তোমাদের মোবাইল ফোন ব্যবহার নিষেধ। এ কথা যেন খুব ভালো করে মনে থাকে।’
‘জি, স্যার!’
‘অফিসের সবাই কখন বের হয়েছে?’
‘ঠিক পাঁচটায় স্যার!’
দারোয়ানের কথায় খুশি হয় সুজন। ‘অফিস আওয়ারের পর কেউ অফিসে থাকবে না’ – সুজনের আদেশ সবাই বেশ ভালোভাবেই মেনে চলছে। দুশ্চিন্তা মুক্ত হয়ে নিজের অফিস রুমে প্রবেশ করে। সে নিশ্চিত বউকে কেউ এখান থেকে ফোন করে কিছু বলেনি। সে তার স্বভাবসুলভ টেকনিকে সুজনকে ঘায়েল করার চেষ্টা করেছে। ঘড়ির দিকে তাকায়। সাতটা পঞ্চাশ। অফিস আওয়ার এর বিষয়টা নিয়ে নিজের কাছেই খটকা লাগে তার। ওয়াশরুমে ঢুকে ফ্রেশ হয়ে রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে।
‘স্যার, সাবধানে যাবেন। রাতের রাস্তা!’
পেছন ফিরে সুজন বলল, ‘তোমাকে আর জ্ঞান দিতে হবে না। তুমি তোমার কাজ করো।’ তারপর গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে মনে মনে বলে, ‘রাতের বেলা রাস্তা কি দিনের থেকে আলাদা হয়ে যায়? যতসব কুসংস্কার! এই রাস্তার প্রতিটা বাঁক আমার মুখস্থ!’
কিন্তু সাদা শাড়ির অতিথির কথা আর হাসির ফ্ল্যাশব্যাকে রাঙ্গামাটির মুখস্থ রাস্তাগুলো সুজনের কাছে এলোমেলো হতে থাকে। প্রতিটা বাঁক তার কাছে নতুন মনে হয়। এর মাঝে বোটট্রিপের কথা মাথায় আসে। সুজনের মনে হয় সে রাঙ্গামাটি ছেড়ে অন্য কোথাও এসেছে। এখানকার রাস্তা তার অচেনা। বাঁকগুলো অচেনা। রাস্তার দুপাশের গাছগুলো অচেনা। এত অচেনার ভিড়ে রাস্তার পাশে আচমকা একজোড়া চোখ দেখে সুজন। অন্ধকারে জ্বলজ্বল করছিল। সুজনের চোখজোড়া ক্ষণিকের জন্য ঝলসে যায়। দ্রুত ব্রেক করে গাড়ি থামানোর চেষ্টা করে। গাড়ি থামতে থামতে রাস্তার একদম পাশে চলে আসে। মুহূর্তেই ছিটকে পড়ে নিচে।
সুজনের যখন জ্ঞান ফেরে তখন দেখতে পায় সে একটা কাঠের অসমান বেঞ্চের উপর বসে আছে। পাশে সাদা শাড়ি পরা সেই অতিথি। সেই-ই তাহলে এখানে এনেছে তাকে। সুজন ভাবে, গাড়িটা কোথায়? গাড়ি যেখানেই থাক সমস্যা নাই। সে যে বেঁচে আছে এটাই বড়ো কথা।
‘কেমন লাগছে এখানে?’ সেই মিষ্টি কণ্ঠ! হাসিটা আবছা আলোয় ঠিক বোঝা গেল না।
‘ভালো! খুব ভালো!’
‘আপনার সবুজে মোড়া ডাক বাংলো এখান থেকে কি খুব বেশি দূরে?’
সুজন এদিক ওদিক দেখে জায়গাটা চেনার চেষ্টা করে। অন্ধকার একদম গাঢ় না হলেও যেটুকু আছে তাতেই খুব বেশি কিছু নজরে পড়ে না সুজনের। সামনে সমান মতো কিছু জায়গা। মাঝে মাঝে উঁচু ঢিবির মতো। আশেপাশে কোনো বসতির চিহ্ন পর্যন্ত নেই। নিকটেই লেকের একটা অংশ থাকতে পারে। বাতাসে লেকের পানির ছোটো ছোটো ঢেউ পাড়ে আছড়ে পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। সুজনের পরিচিত একটা শব্দ। সবুজে মোড়া ডাক বাংলোর নির্জন বারান্দায় বসে অনেকদিন এ শব্দ শুনেছে সে।
‘আপনার সবুজে মোড়া ডাকবাংলো এখান থেকে কি খুব বেশি দূরে?’ একই প্রশ্ন আবার।
সুজন বলে, ‘জায়গাটি একদমই অচেনা মনে হচ্ছে আমার কাছে! এদিকটায় কখনও আসা হয়নি আমার।’
‘অনেক নিরিবিলি! তাই না?’
‘হ্যাঁ! অনেক!’
‘পানির শব্দ পাচ্ছেন?’
‘হ্যাঁ।’
‘ওখানে একটা বোট বাঁধা আছে। চলেন একটা বোট ট্রিপে যাই। লেকে পড়ে থাকা সাদা কুয়াশার বুক চিরে দূরের নির্জন ডাকবাংলোয়। সেও মনে হয় সাদা কুয়াশায় ঢেকে আছে। ঠিক আমার পরনের সাদা শাড়ির মতো। যাবেন?’
সুজনের রক্তে সন্ধ্যের সেই দাপাদাপি নেই। বেঞ্চের ওপরে রাখা তার হাতের ওপর মেয়েটা যখন তার হাত রাখল, সুজন বাতাসের ঝাপটায় পড়া মোমবাতির মতো দপ করে নিভে গেল। এরপর সে সম্মোহিতের মতো সাদা শাড়ি পরা মেয়েটার অতিথি হয়ে তাকে অনুসরণ করতে লাগল। বোট ট্রিপে যাচ্ছে সে। সাদা কুয়াশার বুক চিরে। সাদা কুয়াশায় ঢাকা নির্জন ডাকবাংলোয়। এতসব সাদার ভিড়ে হঠাৎ নিজের দিকে চোখ পড়ে সুজনের। তার গায়ে রঙিন পোশাকের বদলে সাদার ঝকমকানি। গলার কাছে একটু বেশি চাপা। দম বন্ধ হয়ে আসছে সুজনের। কিছুক্ষণ পরে যখন শ্বাস নেওয়া একদম বন্ধ করে দেয় সে, তখন একটা প্রশান্তি ছড়িয়ে পড়ে পুরো দেহে। ততোক্ষণে সে মেয়েটার সাথে বোটে উঠে পড়েছে। ধীরে ধীরে সাদা কুয়াশায় ঢাকা পথ পাড়ি দিয়ে তারা এগিয়ে যাচ্ছে সাদা, নির্জন ডাকবাংলোর দিকে। সাদা শাড়ি পরা মেয়েটার অতিথি হয়ে। পানির শব্দ ছাড়া কারো মুখে কোনো শব্দ নেই। নীরবে তারা চলেছে নির্জনতার পথে।
(প্রথম প্রকাশ- দৈনিক যুগান্তর, ২৪ মে ২০২৪)