শাস্তি
বাসর রাতটা কোনোরকমে পার করে বিন্তি সকাল বেলাতেই বুঝতে পারে পার্কে, রাস্তার পাশে, রেস্টুরেন্টে বসে প্রেম করা, আর সংসার করা এক জিনিস নয়।
রাতে মোট পাঁচটা ইস্যু নিয়ে শাকিলের সাথে ঝামেলা হয়েছে বিন্তির। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এই পাঁচটা বিষয় তাদের প্রায় দুই বছরের প্রেমের মাঝে কখনও উঁকি দেয়নি।
এক। মশারি। বিন্তি মশারি সহ্য করতে পারে না। দম বন্ধ হয়ে আসে। মশা তার শরীর থেকে ব্যাগের পর ব্যাগ রক্ত নিয়ে যাক, পারলে তার রক্ত দিয়ে ব্লাড ব্যাংক তৈরি করুক, বিন্তির কোনো সমস্যা নাই। সমস্যা একটাই, সে কোনোভাবেই মশারির ভেতরে ঘুমাতে পারবে না। মশারিতে ঢুকলেই মনে হয়, সে কবরে ঢুকে পড়ছে। শাকিল একদম উল্টো। মশারি ছাড়া সে ঘুমাতে পারে না। ঘরে মশা থাক বা না থাক, মশারি তাকে ফেলতেই হবে। বাধ্য হয়ে বিন্তি মশারির ভেতরে ঢুকে মাথা পর্যন্ত কাঁথার মধ্যে ডুবিয়ে রেখেছিল, যাতে মশারি তার চোখে না পড়ে।
দুই। জানালা। বিন্তি সবসময় ঘরের জানালা খুলে ঘুমাতে অভ্যস্ত। শাকিল জানালা খুলে রাখার বিপক্ষে। “এটা ঢাকা শহর। রাতে জানালার গ্রিল কেটে চোর ঢুকবে ঘরে।” বিন্তি কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলেছিল, “শাকিল, আমাদের এই অ্যাপার্টমেন্ট তের তলায়।”
“বিল্ডিং কয় তলা?”
“চৌদ্দ তলা।”
“চোরদের বিল্ডিঙের ছাদ থেকে মাত্র একতলা নিচে নামতে হবে। তোমার চেয়ে ওদের বুদ্ধি অনেক বেশি।” শাকিলের মুখে বিজয়ের হাসি।
বাধ্য হয়ে জানালা বন্ধ করেই ঘুমাতে হয়েছিল বিন্তিকে। তার সাতাশ বছরের জীবনে সম্ভবত এই প্রথম।
তিন। ডিম-লাইট। বিন্তি অন্ধকারে ঘুমাতে পারে না। কিছু না হলেও অন্তত একটা ডিম-লাইট থাকতে হবে। শাকিলের চোখে আলো পড়লে ঘুম আসে না। সে বলেছিল, “রাত মানেই তো অন্ধকার। বুঝেছ, অন্ধকার হতে হবে। নিকষ কালো অন্ধকার। তাহলেই পাবে রাতের মজা।”
শাকিল ঘরটাকে ঠিকই নিকষ কালো অন্ধকার বানিয়ে রেখে রাতের মজা ঠিকই নিয়েছিল। স্যাক্রিফাইস করতে হয়েছিল বিন্তিকে। উপায় না দেখে সে কাঁথার মধ্যে তার মোবাইলের স্ক্রিন টাইম-আউট দশ মিনিট সেট করে মোবাইলটা অন করে রেখে দিয়েছিল। অন্তত ঘুমানোর আগ পর্যন্ত চোখের সামনে কিছুটা আলো ছিলো।
চার। গন্ধ। বিন্তি দুই বছরে শাকিলের শরীর থেকে হাল্কা, মিষ্টি একটা গন্ধ পেত। সে ভেবেছিল এটা শাকিলের শরীরের গন্ধ। গত রাতে তার ভুল ভেঙেছে। ওটা ছিল একটা পারফিউমের গন্ধ। কাল শাকিলের পারফিউমের গন্ধের মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ায় শাকিলের শরীরের আসল গন্ধটা পেয়েছে। একদম উটকো একটা গন্ধ। প্রথমে তো তার প্রায় বমি হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। অন্যদিকে সরে গিয়ে কোনোরকমে নিজেকে সামলে নিয়েছিল। সময়ের সাথে সাথে হয়ত সয়ে যাবে গন্ধটা। তবে বিন্তি নিশ্চিত যে তার অনেক সময় লাগবে।
পাঁচ। নাকডাকা। শাকিলের গায়ের গন্ধ, মশারি, জানালা, রাতের নিকষ কালো অন্ধকার, সবকিছু মেনে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিল বিন্তি। অপরিচিত একটা শব্দে হঠাৎ ঘুম ভেঙে তার। শাকিলের নাক ডাকার শব্দ। কিছুক্ষণ পরপর একটা গর্জন হচ্ছে। প্রথমে অদ্ভুত লাগলেও ঘণ্টাখানেক পর কিছুটা সহজ হয়ে গেল। মানুষটা যে শান্তিতে ঘুমাচ্ছে এটা দেখেই ভালো লাগছিল তার।
বিয়ের প্রথম সপ্তাহ পেরোতেই এক সকালে শাকিল অফিস যাওয়ার পর বিন্তির শাশুড়ি তার ঘরে আসে। বিন্তির হাত তার মুঠোর মধ্যে নিয়ে বলে, “শাকিল কি তোমাকে কিছু বলেছে, মা?”
“কোন বিষয়ে, আম্মা?”
“এই এমন কিছু যাতে তোমার মন খারাপ হয়েছে!”
“না, আম্মা। এমন কোনোকিছু তো আমাকে বলেনি!”
সেই শুরু। কয়েকদিন পরপরই তার একই প্রশ্ন। “শাকিল কি তোমাকে কিছু বলেছে, মা?”
বিন্তির নির্লিপ্ত উত্তর, “না, আম্মা। এখনও কিছু বলেনি।”
শাশুড়ির এরকম ব্যবহারে বিন্তি একটু আশ্চর্য হয়। কিছুটা চিন্তিতও হয়ে পড়ে। “কী এমন কথা শাকিল তাকে বলতে পারে যা নিয়ে উনি দিনের পর দিন অস্থিরতার মধ্যে আছেন?” একবার ভাবে উনাকেই সরাসরি জিজ্ঞেস করবে। পরক্ষণেই থেমে যায়। “দরকার নেই। যদি ভয়ংকর কোনোকিছু হয়!”
বিয়ের প্রায় ছয়মাস পেরিয়ে গেছে। বিন্তির দিন ভালোই কাটছে। বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এ বাসায় ঐ একটাই মূলত তার কাজ। শ্বশুর অসুস্থ মানুষ। প্যারালাইজড। এক রুমে বন্দী জীবন। রুটিন করে দিনে দুই তিন বার তার কাছে গিয়ে কিছুক্ষণ বসতে হয়। রান্নার কাজ কাজের মেয়েকে নিয়ে বিন্তির শাশুড়িই করে। মাঝে মাঝে বিকেলের দিকে তার ঘরে এসে বলেন, “একটু চা করবে, মা? তোমার হাতের চা খুব সুন্দর।”
বিন্তি হাসিমুখে ছুটে যায় রান্না ঘরে। চা নিয়ে দুই বউ শাশুড়ি বারান্দায় বসে কথা বলে। কথার এক ফাঁকে তার সেই গৎবাঁধা প্রশ্ন, “শাকিল কি তোমাকে খারাপ কিছু বলেছে মা?”
“না, আম্মা। আপনার ছেলে খুব ভালো। খারাপ কিছু বলতে যাবে কেন?”
উনার দীর্ঘশ্বাস ফেলার শব্দ বেশ স্পষ্টভাবেই বিন্তি শুনতে পায়।
বিয়ের প্রায় বছরখানেক পেরিয়ে এক রাতে শকিলের মুখে কিছু কথা শুনে একদম স্তম্ভিত হয়ে যায় বিন্তি। বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় টিকতে পারেনি সে। শাশুড়িকে বিকেলেই বলেছে সেটা। উনি মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলেছেন, “মন খারাপ করার কিছু নাই মা। আবার চেষ্টা করো। পরের বার নিশ্চয় হবে তোমার।”
রাতে ঘুমাতে গিয়ে শাকিলকে পরীক্ষার ফলাফলের বিষয়টা বলতেই এমন কথা বলে সে যা ভাবতেও বিন্তির চোখ দিয়ে পানি ঝরছে।
পরদিন সকালে নাশতার টেবিলে বসেও কথাটা মনে হওয়ার সাথে সাথে চোখ থেকে কয়েক ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ে। বিষয়টা বিন্তির শাশুড়ির চোখ এড়িয়ে যায়নি। ছেলে অফিসে রওনা হওয়ার সাথে সাথে বিন্তির ঘরে ছুটে আসেন। বিন্তির হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে নিয়ে বলেন, “কাঁদছ কেন মা? শাকিল কি তোমাকে খারাপ কিছু বলেছে?”
বিন্তি কোনোরকমে কান্না সামলে নিয়ে বলে, “জি, আম্মা। অনেক খারাপ একটা কথা বলেছে।”
“কী বলেছে মা? আমাকে বলো। আমি শুনতে চাই। তোমার কান্না বন্ধ করো।”
“আমি সে কথা মুখে আনতে পারব না, আম্মা।”
“আমি তো তোমার মায়ের মতো। আমাকে বলো, মা।”
বিন্তি কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। এসব শব্দ উচ্চারণ করতেও তার মুখে বাঁধছে। কিন্তু তার শাশুড়ির জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়। “শাকিলকে আমার বিসিএস প্রিলিমিনারির রেজাল্ট বলতেই সে আচমকা এসে আমার চুল ধরে টান দেয়, আর বলে, ঐ মাগী, খাওয়া আর পড়া ছাড়া বাসায় তোর আর কোন কাজ আছে? পরেরটা তোর লাস্ট বিসিএস পরীক্ষা। না টিকতে পারলে তোর মতো মাগীর দরকার নাই এই বাসায়। লাথথি মেরে বাসা থেকে বের করে দেবো।”
কথাগুলো শেষ করেই আবার কাঁদতে লাগলো বিন্তি। শাশুড়ি তার আঁচল দিয়ে চোখের পানি মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, “কেঁদো না, মা। তুমি যত কাঁদবে, শকিলের তত অমঙ্গল হবে। তোমার শ্বশুর আমার সাথে একইভাবে কথা বলত। গায়ে হাত তুলত। আমি কাঁদতাম। মা-বাবা কষ্ট পাবে বলে তাদের কখনও বলিনি। শুধু জায়নামাজে বসে আল্লাহ্র কাছে কান্নাকাটি করতাম। তোমার শ্বশুরও কথায় কথায় লাথি মারতে চাইত। চুলের ঝুঁটি ধরত। আজ আল্লাহ্ তাকে পঙ্গু করে রেখেছেন। যে পায়ে লাথি দিতেন সে পায়ে শক্তি নাই। যে হাতে চুল টেনে ধরতেন, সে হাতে এখন কিছুই ধরতে পারেন না। তু্মি কি দেখেছ আমি ওনার সামনে গেলেই ওনার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়ে? তুমি আমার ছেলেকে মাফ করে দাও মা। ও কিছু বললে তুমি যেন তোমার চোখের জল ফেলো না। মারপিট আর গালিগালাজ ওদের বংশগত দোষ, মা। ভবিষ্যতে তোমাকে হয়ত আরও খারাপ কথা বলবে। গায়ে হাত তুলবে। আমি তার মা হয়ে তোমার কাছে মাফ চাচ্ছি মা। তুমি আমার ছেলেকে মাফ করে দাও।”
বিন্তি ওর শাশুড়ির আকুতি আর কান্না দেখে তার হাত শক্ত করে ধরে বলে, “আপনি শান্ত হোন, আম্মা। আমি নিজেকে শান্ত রাখতে চেষ্টা করব।”
মুখে বললেও বিন্তি ঠিকই তার ভবিষ্যৎ দেখতে পায়। তিরিশ বছর পর সেও হয়তো তার ছেলে বউকে এভাবেই বলবে। নিজের ছেলের কাজের জন্য মাফ চাইবে। পাশের ঘরে হয়ত প্যারালাইজড এক শাকিল সবকিছুই শুনে যাবে নীরবে। চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়বে। এক ফোঁটা। দুই ফোঁটা। চোখের পানি শুকিয়ে না যাওয়া পর্যন্ত।
(প্রথম প্রকাশ- দৈনিক যুগান্তর, ১৩ জানুয়ারি ২০২৩)