একজন হেলেন অব স্পার্টার দিনলিপি
রাত ২:১৭
ঘরের সব বাতি বন্ধ। জানালার কাচ ভিজে আছে ঝাপসা হয়ে যাওয়া জলের ফোঁটায়। সেই জলে হাত রাখতেই শরীরে শিহরণ জাগে, তার স্পর্শের আবহে। তার কথা মনে পড়তেই বুকের ভেতরটা কেঁপে ওঠে।
পাগলটার যে কী হয়েছে আজকাল। চুলে তেল দেয়, সিঁথি করে, ইস্ত্রি করা কাপড় পরে, সোজা হয়ে হাঁটে, সোজা হয়ে বসে, আমার চুলের গন্ধ নিতে নাকের সাথে তার মাথাটা আর আগের মতো এগিয়ে আসে না আমার দিকে, হেলে পড়ে না। হাতে মাখা লোশান হারানোর ভয়ে হাতটাও ধরে না ইদানীং, ব্যস্ততার ভান ধরে চোখের দিকে তাকায় না। বেশি কথাও আর বলতে চায় না। তার চোখে ভয়, ঠোঁটে ভয়, হাতে ভয়। অথচ প্রথম দেখার দিনেই আমার চোখে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে কত সাহস করেই না বলেছিল, ‘আমার একটা ‘ট্রয়’ আছে, চলো পালিয়ে যাই!’
এই এক বাক্য যেন আমার বুকের গোপন বন্দরের দরজা। দরজা খুললেই বাতাস বদলে যায়। আমি জানি, আজও জানি, দরজা খুললেই শহর জ্বলে উঠবে। আমি তার কথা শুনে থরথর করে কেঁপেছি, চোখ বুঝে ভেবেছি, ‘আমি তো হেলেন অব ট্রয় নই, আমি হেলেন অব স্পার্টা, সংসারী মানুষ, স্বামী আছে, রান্না আছে, ঘর সামলানো আছে, কাপড় গুছানো আছে, পানি ফুটানোর কাজ আছে। আমি নিজে ফুটতে থাকলে তো সব শেষ হয়ে যাবে।’
তারপরও ধীরে ধীরে, পাগলের কথায় আর হাসিতে, ভেতরে ভেতরে, দিনে দিনে, অনেক ফুটতে শিখেছি। মাঝে মাঝে সুনামির মতো এমন ঢেউ জেগে উঠতো, মনে হতো এজিয়ান সাগরের এপার থেকে আমাকে নিয়ে আছড়ে ফেলে দেবে ট্রয়ের বালিতটে। স্পার্টার হেলেন হয়ে যাবে হেলেন অব ট্রয়। সে কিন্তু এই সুনামিই চেয়েছে আমার চোখে। আর আমি পাকা রাঁধুনির মতো পাতিল থেকে দুধ উথলে ওঠার আগেই চুলার আঁচ কমিয়ে দিয়েছি। যে ঢেউ এখন স্পার্টার এদিকটায় জাগে, তা আর তীর থেকে এগোয় না। বরং বারবার ফিরে এসে আমাকেই আঘাত করে। আর আমি প্রতিটা ঢেউয়ের আঘাতে প্রতিটা মুহূর্তে ক্ষতবিক্ষত হয়ে চলি অবিরাম। তবু ছাড়তে পারিনা ঢেউয়ের নেশা।
রাত ২:৩৯
ডেস্কের ডায়েরি খুলে দেখি পুরোনো পাতায় লেগে থাকা চায়ের দাগ। দাগ মানে তো অস্তিত্বের প্রমাণ। ভালোবাসাও মাঝে মাঝে দাগ হয়ে থাকে, মুছতে চাই না, তবু চোখে পড়ে, তবু ব্যথা বাড়ায়।
আমার স্বামী ঘুমোচ্ছে। তার ঘুমের শব্দ, আমি যাকে বলি স্পার্টার গুঞ্জন, ধীরে ধীরে আমার স্নায়ু জুড়ে ছড়িয়ে যায়। আমার ঘরে এই শব্দে নিরাপত্তা আছে। দরজার চাবি, রান্নাঘরের অ্যাডজাস্ট ফ্যান, শুকোতে দেওয়া তোয়ালে, সব কিছুর সাথে সুর মিলিয়ে নেয় এই শব্দ।
আর আমার ভেতরের ঢেউ? সে চায়, আমি উঠি, দরজা খুলি, অন্ধকারের দিকে হাঁটি। সে চায়, আমি নাম বদলাই, হেলেন অব স্পার্টা থেকে হেলেন অব ট্রয় হই।
সে যে কেন বদলে গেল, বা আদৌ বদলেছে কিনা, কখনও কখনও আমারই সন্দেহ হয়। হয়তো আমিই বদলে গেছি, কখন যেন আমার চোখে সময়ের কারচুপি ঢুকে গেছে, সেই চোখে আগের ঝড়ের নেশা নেই। তবু পাগলটার চোখের ভেতর ঢুকে থাকা আগুন, যেটা আমাকে ফুটাতে শিখিয়েছিল, সেটা নিভে যেতে দেখে বুকের ভেতর ভার জমে ওঠে।
আমরা দুইজন, দুই জগতের দুই শব্দমালা। একদম শুরুতে যখন দেখতাম, কী অদ্ভুতভাবে ওর শব্দমালা আমাকে ঘিরে বৃত্ত তৈরি করে রাখতো, মনে হতো আমি যেন একটা গল্পের নায়িকা। তারপর হঠাৎ কেমন এক নিঃশব্দ বর্ষা নেমে এল, যেটার বৃষ্টি নেই, শুধু ভেজা গন্ধ। সেই গন্ধে মুগ্ধ হওয়া যায় না, সেই গন্ধে শুধু পুরোনো কাপড়ের ভাঁজে আটকে থাকা দুঃখের গন্ধ লেগে থাকে।
প্রথম দিকে ও বলত, ‘তুমি হাসলেই যুদ্ধ থেমে যায়।’
আমি হাসতাম। বোকা দু’জন মানুষ, ভাবতাম আমরা আলাদা গ্রহের, হয়তো ছিলামও, হয়তো এখনো আছি। কিন্তু একদিন দেখি, তার চোখে যুদ্ধের আগুন নেই, আছে কেবল হিসেব, যত্নের হিসেব, নিরাপত্তার হিসেব, ভবিষ্যতের হিসেব। ভালোবাসা নাকি ভয় পায় হিসেবকে। আমি নিজের চোখে দেখলাম, ভালোবাসা যখন বড় হয়ে উঠে, তখন সে নিজের ঘরেই বন্দী হয়।
সে আগে বলত, ‘যা বলবে, করবো, শুধু হাতটা দিও।’ এখন বলে, ‘থাক, পরে কথা বলবো, কাজ আছে, ব্যস্ত আছি।’
আমার হাতটা শূন্য হয়ে থাকে। আমার রাগ হয় না, একধরনের কষ্টে জমাট যাওয়া নিস্তব্ধতা নেমে আসে। কখনো মনে হয় আমি যেন মিউজিয়ামের কোনো পুরোনো শিল্পকর্ম, যেটা একসময় মানুষ দেখে বিস্মিত হতো, এখন দেখে কিন্তু কথাও বলে না, শুধু লেবেল পড়ে চলে যায়।
রাত ৩:১২
আমি আয়নার সামনে চুল আঁচড়াই। আঙুলে আঙুলে জড়ানো নরম, পরিচিত এক গন্ধ। মনে পড়ে, কখনও সে মাথা হেলিয়ে আমার চুলের গন্ধ নিত। এতটাই কাছে, এমন দুঃসাহসে, যেন নেশার দোকান খোলা আছে আমার ঘাড়ের ত্বকে। চুলের ভেতর আঙুল চালিয়ে দেখি, সেই গন্ধ এখনও আছে। কেন থাকে? কেন আমি ধুয়ে ফেলি না? হয়তো আমি ভয় পাই, ধুয়ে ফেললে, আমি আর ‘আমি’ থাকব না। নেশা, সাহস, আকর্ষণ, সব যেন মিশে আছে এই গন্ধে।
এখন সে তেল দেয় চুলে, সিঁথি করে। ভয় লাগে, সেই সিঁথির এক পাশে আমি, অন্য পাশে তার নতুন জগত। আমার দিকে সে আর হেলে পড়ে না। হয়তো সে শিখে গেছে, যে প্রেম ঝুঁকে আসে, সে প্রেম একদিন পিঠও দেখায়।
তবু, আমার ভেতরে যে ঢেউ ওঠে, আমি কাকে বোঝাই? ঢেউয়ের সাথে আমার গোপন বোঝাপড়া, উথলে উঠা দুধের মতো, তুমি উঠো, আর আমি আঁচ কমাই। তুমি ভেজাও, আমি তোয়ালে শুকাই। তুমি ঝড় তোলো, আমি ঘর বাঁচাই, আমি নিজেকে বাঁচাই।
আমি নিজেকে মাঝে মাঝে ট্রয়ের প্রাচীর ভাবি। বাইরে আগুন, ভেতরে গোপন যুদ্ধ, আর মাঝে আমি দাঁড়িয়ে। ও বলেছিল একদিন, ‘তোমার মনের ভেতর ট্রয় আছে। তোমার ভেতরের আগুন আমি দেখেছি।’
কেউ না জানলেও আমি জানি, সেই আগুন এখনও রয়ে গেছে, কিন্তু বৃষ্টি পড়ে না, জোয়ার আসে না, আসে শুধু শুকনো হাওয়া। তাতে আগুন দপদপ করে না, এখন শুধু ছাই ধুলো হয়ে উড়ে যায়।
একসময় ওর সাথে কথা বলতে বলতে রাত পেরিয়ে যেত। আমরা গল্প বানাতাম। সে বলত, ‘আমরা পালাবো!’
আমি বলতাম, ‘কোথায়?’
সে বলত, ‘কোনো দূর সমুদ্রের ধারে। যেখানে কেউ আমাদের চেনে না।’
আমি হাসতাম, বলতাম, ‘আমাদের দুজনের মধ্যে যত সমুদ্র, তার তীর খুঁজে পাওয়াই দায়! দূরে আর কোথায় যাব?’
সে মুগ্ধ হয়েছিল এই কথায়। এখন সেই কথাগুলোও নিজের সাথে আমি একাই বলি।
রাত ৩:৩৫
চোখ ভারী হয়ে আসছে। আমি বিছানায় যাই। জানি, ঘুমের আগে আবার ঢেউ আসবে। ঢেউকে ভয় লাগে না, ঢেউ আমাকে বাঁচায়। আমি যদি আর কিছু অনুভব না করি, সেটাই তো মৃত্যু।
সব নিভে গেছে। শুধু আমার বুকের মধ্যে একটি আলোকবিন্দু জ্বলছে। স্বামী ঘুমিয়ে, বাতির নরম আলোয় তাঁর গাঢ় নিঃশ্বাস স্থির হয়ে আছে। আমি বিছানার কিনারায় বসে আছি। মনে হচ্ছে যেন রাতের মাঝখানে আমার হৃদয় হাঁটছে, শব্দ শুনি। কোনো শহর জ্বলে উঠছে না, কোনো দরজা খুলছে না, শুধু খুব উষ্ণ অস্থিরতা।
আমি জানি, এখন একটা বার্তা এলেই আমি থরথর কাঁপব। কিন্তু বার্তা আসে না। সে না পাঠিয়ে আমাকে বাঁচায়? নাকি শাস্তি দেয়? কে জানে।
তবুও আমার শরীর যেন মনে রেখেছে, কীভাবে দুঃসাহসের ছায়ায় শ্বাস নিতে হয়। আমি চোখ বন্ধ করি, আর নিঃশ্বাস ফেলি ধীরে, যেন আগুন ছাড়াই ছাই উড়িয়ে দিচ্ছি।
হঠাৎ ফোনটা নড়ে ওঠে। স্ক্রিনে আলো জ্বলে, এক লাইনের বার্তা, ‘তোমার চুলের গন্ধ মনে পড়ছে।’
এতটাই যথেষ্ট। বুকের বাম পাশে একটি আগুনের বিন্দু লাফায়। এক আঙুল পরিমাণ এগিয়ে যায়, তারপর থেমে যায়। আমি ফোনটা উল্টো করে রাখি। তবু দেহে রাতের স্রোত। আগুনের বিন্দু বুকের ভেতর ছড়িয়ে পড়ে। ঘরের ভেতর শাঁ শাঁ শব্দ, চুলার না, আমার শিরায়। আমি একবার গভীর শ্বাস নিই। আরেকবার। যেন প্রতিটি শ্বাসেই যুদ্ধ।
তাই আমি ঘরের ভেতরও দরজা খোলা রাখি, বাতাস ঢোকে, বেরোয়। আমার ভেতরের ঢেউ দম নেয়, ঘুমোতে শেখে।
সকাল ৭:৪৮
আমি চোখ খুলি, কিন্তু ঘুম পুরো যায় না। জানালার ফাঁক দিয়ে যে আলো ঢোকে, তা কোমল নয়, চোখে বিঁধে। আমি বুঝি, ভোর আজ একটু বেশি জ্বলে।
আলো আরেকটু গাঢ় হলেই বিছানা ছেড়ে উঠি। জানালার কার্নিশে বসে থাকে দুটো চড়ুই। আমার মনে হয় স্পার্টার দুই প্রহরী। তারা শিস দিয়ে আমাকে মনে করায়, আজও তোমাকে টিকিয়ে রাখতে হবে, টিকে থাকতে হবে।
রান্নাঘরে ঢুকে দেখি, গত রাতের ধোঁয়া আর চায়ের গন্ধে মিশে আছে একটি নিঃশ্বাস, নরম, অচিন, তবু চেনা।
চা বানাতে যাই। কেটলি আগুনে বসাই। আগুনের শিখা ছোটই ছিল। হঠাৎ করে খুব বেশি বাড়ালাম। নিজের অজান্তে। নীলাভ শিখা লালচে হতে দেখেই বুকের মধ্যে আগুনের রেখা টেনে উঠল। সাথে সাথে চুলার আঁচ কমিয়ে দিলাম, মনে হল, আগুন আমার দিকে তাকিয়ে বলছে, ‘তুমি আমায় কমাও, কিন্তু আমি তোমার মধ্যে বাড়ি।’
আমি কাপে দুধ ঢালি, আর একটু ঝুঁকে দাঁড়াই। সেই ঝুঁকে থাকা দেহে, অকারণে, কারো স্পর্শের স্মৃতি জমে থাকে বহুদিন, অনেকদিন। আমার পিঠ হালকা শিরশির করে। কে যেন অদৃশ্য আঙুল দিয়ে টেনে দেয় এক সুদীর্ঘ রেখা, ঘাড় থেকে শুরু হয়ে পিঠ বরাবর নেমে যায়। আমি স্থির হই। শ্বাস আটকে আসে। নিজের শরীরকে বোঝাই, শান্ত হও। এটা শুধু একটা সকাল, শুধু এক কাপ চা, শুধু নিজের এক পশলা নিঃশ্বাস। কিন্তু শরীরের ভাষা শরীরই বোঝে। নেশার ইতিহাস কোনোদিন মুছেও কি মুছে?
এক কাপ চা যখন আমার জিহ্বায় ক্যাফেইন ছাড়ে, আমি ডায়েরিতে জলের মতো কিছু বাক্য ঢালি, প্রেম মানে সব সময় দৌড় নয়, কখনও কখনও থেমে যাওয়া, দাঁড়ি-কমা নয়, একেবারে কানাগলি।
আমার স্বামীর ভেতরে যে শান্ত নদী, তার পাশে বসলে আমি গল্প বলতে পারি। আমার ছেলেবেলার কথা, আমার প্রথম ভয়ের কথা, প্রথম বার কাঁধে রাখা হাতের ওজন। তিনি শোনেন। প্রশ্ন খুব কম করেন। তার শোনা, এই শহরের সবচেয়ে নিরাপদ সড়ক।
আর যে পাগলটা, সে কথা শোনে না, সে কথা জন্ম দেয়, কথা থেকে আগুন বানায়, আগুন থেকে রাতে খোলা দরজায় হাওয়া ছোটে। আমি মুগ্ধ হই, আমি ভয় পাই।
সকাল ৮:৪০
থালাবাটি ধুতে ধুতে হঠাৎ মনে হল, আমার নখের কোণে আটকে থাকা হলুদ রঙটাই হয়তো আমার দেশ। হলুদ মানে রান্না, শিকড়, ঘ্রাণ; হলুদ মানে বিদায়ও, বউয়ের কপালের টিপ, গায়ের হলুদ, বিয়ের আগের রাতের কাঁপন।
আমি কি প্রতিদিন বিয়ে করি? প্রতিদিন বিদায় নিই? নিজেকে? নাকি তাকে? সিঙ্কে জলের শব্দে বুঝি, আমার ভেতরের সুনামির আওয়াজ ঢেকে রাখা যায়। তবু ঢেউ জানে, আমি আছি।
ডাইনিং টেবিলের এক কোণে একটা ঝুড়ি আছে। তাতে শুকিয়ে যাওয়া গোলাপের পাপড়ি, পুরোনো কাগজে লেখা কিছু শব্দ, একটা চিরুনি, কয়েকটা ছবি। আমি বলেছিলাম একদিন, ‘এসব রেখে কী হবে?’
সে বলেছিল, ‘স্মৃতিরও আশ্রয় লাগে।’
এখন মনে হয়, স্মৃতি কেন শুধু আমার ঘর পায়? কেন চলে যায় না? কেন বোঝে না, এখানে তার জন্য জায়গা নেই? তবু রাত হলে আমি ঝুড়িটার দিকে তাকিয়ে থাকি। হয়তো ভালোবাসা এমনই, চলে যেতে চাইলে যায় না, থাকতে চাইলে থাকে না।
সকাল ৯:৪৫
জীবনের সবচেয়ে স্থির জায়গা, আমার রান্নাঘর। সেখানে তাপে দুধ উথলায়। হাঁড়ির ঢাকনায় টুংটাং শব্দ হয়।
ও বলত, ‘তোমার হাতের রান্না আমাকে বন্দী করে রাখবে।’
এখন মনে হয়, ঐ বন্দিত্বই কি ওকে পালাতে বলেছিল? নাকি আমি ভুল বুঝেছি?
কখনো ইচ্ছে করে ইচ্ছাকৃতভাবে চুলায় দুধ উপচিয়ে দিই, আর ভাবি, আগের মতো ছুটে এসে বলবে,
‘পুড়ছে! টুকটুক করে ফুটছে ভালোবাসা।’
কিন্তু আজকাল শুধু চুলার আগুনই টের পাই, মানুষটার উষ্ণতা নয়।
রান্নাঘরের বারান্দার টবে তুলসী গাছ। পাতায় ধুলো। আমি জলের ঝাঁপটা দিই। সবুজটা আবার জেগে ওঠে। তুলসীর এই বেঁচে ওঠা আমাকে শেখায়, কম জল, ঠিক সময়ে জল, আর স্নেহের হাত। আমার প্রেমকেও কি আমি তেমনই সেচে বাঁচিয়ে রাখছি, কম, সময়মতো, দূর থেকে? সে আজকাল খুব ভদ্র। ভদ্রতা, সবচেয়ে বিপজ্জনক অস্ত্র। ভদ্রতা দিয়ে প্রেমকে দূরে সরানো যায়, প্রশ্নকে থামানো যায়, ভেতরের বিপর্যয়কে লুকিয়ে রাখা যায়। সে ভদ্র হয়ে উঠেছে, নিজেকে বাঁচাতে। আমি ভদ্র হয়ে উঠেছি, ঘরকে বাঁচাতে।
সকাল ১০:২৪
জানালায় হঠাৎ আলো খেলে গেল। মনে হল, যেন কেউ চোখের ভাষায় বলল, ‘তুমি লুকোতে পার না। তোমার শরীর সত্য জানে।’ আমি জানালা বন্ধ করি না। জানালায় দাঁড়িয়ে বুক বাড়িয়ে নিই। দুই হাত জানালার কপাট ধরে দাঁড়াই। উষ্ণ কাঠে আঙুল চেপে থাকে। মনে হয়, যেন কারো বাহু আমার দু’দিকে। নেই, তবু আছে। ভর নেই, তবু ভার আছে।
আমি খুব ধীরে একটা শ্বাস নিই। এত ধীরে যে নিজের ভেতরে শ্বাসের শব্দ শুনি, কাঁপনের, নেশার। যেন কোথাও কোনো ঘোড়া গলা ঝাঁকায়। ট্রয়? নাকি শুধু আমার বুকের শব্দ? বাইরের পৃথিবী বেশ শান্ত। কিন্তু আমার শরীর, চুপচাপ আগুন ধরেছে। আর আমি আগুনের মধ্যে বসে চুলা কমাই। নিজেকে নিয়ন্ত্রণে নিই, এটাই রাজত্ব। কিন্তু ইচ্ছে? ইচ্ছে তো সৈনিক। সৈনিকের কাজ হলো এগোনো। আমি সৈনিককে আজ আদেশ দিলাম, থামো, শুধু দেখো, কিন্তু পার হয়ে যেও না।
আজ ভোরে স্বপ্ন দেখেছি। আমি সমুদ্রের ধারে, পায়ে ভেজা বালি। সে দূরে। হাত নেড়ে ডাকছে, ‘হেলেন, এইদিকে!’
আমি দৌড়োই। হঠাৎ দেখি বালির নিচে মাটির হাঁড়ি পোঁতা, হাঁড়িতে দুধ ফুটছে। হাঁড়ি আমার ঘর। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি। সে ডাকতে থাকে। আমি হাঁড়ির আঁচ কমাই। দুধ থিতিয়ে আসে।
জেগে দেখি, বাস্তবের চুলায় শীতলতার আঁচ, তবু স্বপ্নের আঁচ আমার আঙুল জ্বালিয়ে দিয়েছে, আমি বুঝতে পারি, আমার বাঁচার কৌশলই আমার শরীর।
দুপুর ১২:১৫
জানালার পাশে বসেছিলাম। বাইরে আকাশ খুব নীল। নীলের মধ্যে এমন শান্তি ছিল যেন আকাশও থমকে আছে। আমি ফোনটা হাতে নিয়েছিলাম। ওর নামটা দেখলেই আমার বুকের ভেতর ঢেউ ওঠে, এখনও ওঠে। ভাবলাম, ফোন দেবো, আর বলব, ‘ফিরে এসো। নিঃশ্বাসের মতো এসে দাঁড়াও পাশে। আমি আছি এখনও।’
কিন্তু ওর চির-অচেনা গম্ভীর মুখ। মনে হলো, আমি যে মানুষটাকে ভালোবেসেছিলাম সে কোথায়? এই মানুষটা কে? সেই পুরোনো হাসিখুশি, দুষ্টুমি-ভরা চাহনি কোথায়?
ফোন দিইনি।
জানালার ধারে বসে ভাবলাম, আমরা কি একে অপরের ভুল সময়ের মানুষ? এমনও কি হয়? দুজন মানুষ একই সাথে জ্বলে উঠতে পারে না? একজন জ্বলে, অন্যজন ছায়ায় দাঁড়ায়। তারপর একদিন আগুন নিভে গেলে ছায়া আর কোথাও যাওয়ার জায়গা পায় না।
কোথাও কি ভুল হয়েছে?আমি ভাবি, আমিই কি খুব সাধারণ হয়ে গেলাম? ও কি খুব বিশেষ হয়ে গেল? নাকি আমরা দুজনেই মাঝখানে কোথাও পড়ে গেলাম?
আমরা কি খুব বেশি বড় হয়ে গেছি? এখন ওর কথায় নিরাপত্তা, যুক্তি। আমার কথায় ভয়, অনিশ্চয়তা।
প্রেম কি এমনই হয়? প্রথমে ঝড়, তারপর ভাঙা ঠোঁট, তারপর শান্ত নদী, তারপরে শুকনো পাথর? আমি চুল শুকাতে শুকাতে আয়নায় তাকালাম। আমার চোখে কে বাস করে এখন? সেই হেলেন? নাকি রান্নাঘরের ধোঁয়ার মধ্যে বাঁচতে থাকা সাধারণ গৃহিণী? আমি দুজনকেই চিনি, দুজনই আমি, তবু দুজনই একে অপরকে ভয় পায়।
দুপুর ১২:৫৮
কাপড় ভাঁজ করতে করতে মনে হয়, এই ভাঁজ করা কি আমারই প্রতিচ্ছবি? ভালোবাসাকে, ইচ্ছে-আকাঙ্ক্ষাকে, উড়ে যাওয়া স্বপ্নগুলোকে, সবকিছুকে ভাঁজ করে রেখে দিই কাপড়ের মতো। আলমারির মতোই বুকেও তাক আছে। সেখানে গুছানো থাকে স্পর্শের স্মৃতি। একটা শাড়ি ভাঁজ করতে গিয়ে হঠাৎ আঙুলগুলো থমকে দাঁড়ায়। মনে পড়ে, ও বলেছিল, ‘শাড়িতে তোমাকে আগুনের মতো লাগে।’
আমি চোখ বন্ধ করি, শাড়ির ওপর হাত রেখে দাঁড়াই, আমার শিরায় শিরায় বিদ্যুৎ ঝলক দিয়ে যায়। শাড়ির কাপড়ে গোপন তাপ লেগে আছে, আমি জানি। আমি যেদিন কাছে গিয়েছিলাম তার নিঃশ্বাসের দূরত্বে, সে আমার শাড়ির প্রান্তে আগুন রেখে দিয়েছিল। কিন্তু আগুন ধরে রাখা তার কাজ ছিল না, একান্তই আমার, আমি রেখেছি। হঠাৎ মনে হয়, যদি আজ ও ডাকে, যদি বলে, ‘চলো, পালিয়ে যাই।’
আমি শাড়িটা ভাঁজ করি, ধীরে, আরও ধীরে, কারণ আমি বুঝে গেছি, ভাঁজের শব্দেও আগুনের গুঞ্জন লুকানো থাকে।
বিকাল ৩:৫০
চায়ের জল ফুটছে। পাতিল থেকে বাষ্প ওঠে, উড়ে যায়। আমার ভেতর থেকেও বাস্প ওঠে, হালকা, বেশ হালকা। জানালার বাইরে পাখি ডাকে, আমি তাদের ডানা দেখি, তাদের উড়তে দেখি। আমি কি উড়তে পারতাম বাষ্পের মতো, পাখির মতো? হ্যাঁ, চাইলে পারতাম, কিন্তু উড়ে যাওয়া মানে ফেরার রাস্তা হারানো। আমি রোজ বাষ্পদের আর পাখিদের উড়তে দেখি, কিন্তু আমি বেছে নিই শেকড়, ঘর। শেকড়ের, ঘরের সৌন্দর্য আছে, আগুন আছে, যার সবটুকুই নীরব, গভীর, স্থির।
বিকাল ৪:১০
চায়ের কাপ হাতে বারান্দায় দাঁড়াই। রোদ বেশ নরম, তবু চামড়ায় লাগে যেন কেউ উষ্ণ আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে গেল। দূরে রাস্তার ধুলো, মোটরের শব্দ, হাওয়ার সাথে ভেসে আসে দুধ-রুটির গন্ধ। আমার ভেতরের ঢেউ আজ ব্যস্ত, বুকে ছোট ছোট জোয়ার, বারবার এসে থামে, আবার ফিরে যায়। আমি নিজের কাঁধে মাথা রাখার কৌশল শিখেছি, দুটি বাহু দিয়ে জড়িয়ে ধরি নিজেকেই। এই আলিঙ্গনে আগুন কমে না, কিন্তু নিয়ন্ত্রিত থাকে, চোখ বুজে, কল্পনায়।
রাত ৮:১০
আজ আমি আয়নায় নিজের চোখ দেখি, কালো নয়, রঙিন। এই চোখ দুটো জানে কত রঙের ঢেউ উঠেছে, কত রঙিন নিঃশ্বাস থেমেছে তার পটে। আমি আলতো করে নিজের গাল ছুঁই। আমার শরীর আমার যুদ্ধের সঙ্গী, কত কামনার বৃষ্টি সয়েছে, কত প্রার্থনার আগুন ধরে রেখেছে।
আমার ঠোঁটের কোণে হাসি, আমি বেঁচে আছি।
রাত ১০:২০
স্বামী বই পড়ছেন। আলো তাঁর কাঁধে, পিঠে, বইয়ের পাতায়। আমি তাঁর পাশে বসি। বইয়ের পাতা উল্টানোর শব্দে আমার বুকে শিরশিরানি থামে, আমি কাপড়ে ভাঁজ করি আমার তীব্রতা। আমি জানালার বাইরে তাকাই। কালো আকাশ, দূরের আলো, সব যেন সমুদ্রের ধারে দাঁড়িয়ে থাকা রাত। আমার ফোনের স্ক্রিন জ্বলে ওঠে, ‘ঘুম আসে না। তোমাকে মনে পড়ছে’।
শরীর জমে যায়। ঠোঁট শুকিয়ে যায়। আমার আঙুলের ডগায় কাঁপন আসে। উত্তর দিই না। তবু ভেতরে একটি দরজা থরথর করে কেঁপে ওঠে।
তিনি হঠাৎ হাত বাড়ান, আমার হাতের ওপর হাত রাখেন না, পাশেই স্থির করে রাখেন। অনুমতি চান না, দাবিও করেন না, তাঁর এই ‘না ছুঁয়ে’ ছোঁয়া আমাকে একধরনের মুক্তি দেয়। আমি শ্বাস নিই, দীর্ঘ, গভীর, ধীর।
তিনি আবারও হাত বাড়ান, চা এগিয়ে দেন। তাঁর আঙুল আমার আঙুল ছুঁয়ে যায়। আমার সাম্রাজ্য আবার বেঁচে ওঠে।
আমি নিজের কাছে খুব নরম স্বরে বলি, থাকো, এভাবে হলেও থাকো।
রাত ১১:০২
ঘুমের আগে কাপড় গুছোতে গুছোতে ভাবি, আমার ভেতরের ট্রয় কি আজ একটু শান্ত? নাকি পর্দার আড়ালে আগুন-খেলা শিখছে? আমি তাকাই, অপলক চোখে দেখি স্বামীর কাঁধ। কাঁধ মানে তীর। আমি সেখানে মাথা রাখি, মনে হয়, এবারের মতো আমি বেঁচে গেলাম।
তবু অন্য এক সমুদ্র আমাকে ডাকতে থাকে, ‘এসো, দেখো, ডুবে যাও, ডুবে গিয়ে উঠে এসো, আবার ডুবে যাও, ডুবসাঁতার খেলতে থাকো।’
আমি চুপ করে থাকি। আঁচ কমিয়ে দিই।
রাত ১২:২৫
এক গ্লাস দুধ গরম করে খাই। আজ দুধ উথলাতে দিই না, অল্প আঁচে ধীরে ধীরে গরম করি। দুধের ওপর পাতলা স্তর জমে, আমি চামচ দিয়ে আস্তে সরিয়ে নিই। এই স্তর সরানোই যেন আমার জীবন। ভেতরের উত্তাপ থেকে বেঁচে থাকার নিয়ম। আমার স্বামী পাশে ঘুমোচ্ছে, তাঁর শান্তি আমাকে ঢেকে রাখে, যেন খয়েরি রঙা এক শাল। আমি দেখি তাকে, আর মনে হয়, এই ঘরে আগুন লাগতে দেওয়া যায় না। তবুও মনে মনে বলি, তুমি ডাকলেও আমি আসব না। কিন্তু তুমি ডাকো আমাকে যাতে আমি না আসার শক্তি খুঁজে পাই।
রাত ১:৩৭
ঘর ঘুমায়। আমি জেগে থাকি। বুকের ভেতর নরম আগুনের শব্দ। আমি বুকের জানালায় মুখ ঠেকাই। দিনের তাপ জমে আছে ঠোঁটে। আজ আর দমাই না, আজ শুধু অনুভব করি। অনুভব করাই তো প্রথম ও শেষ সৌন্দর্য।
শেষের অপেক্ষায়
কখনো আমি রান্নাঘরের টাইলসে হেলান দিয়ে বসি। ফুটতে থাকা দুধের গন্ধে পুরোনো স্মৃতি জেগে ওঠে। তখন মনে হয়, দুধের মতোই আমরা, উথলে ওঠার আগে নরম সাদা ফেনা, তারপর যদি সতর্কতা ভুলে একটু চুলা বাড়িয়ে দিই, সব উথলে পড়ে ধ্বংস হয়ে যাবে। তাই আমি নিজেকে বার বার কমিয়ে দিই, তাপ কমাই, তীব্রতা কমাই, হৃদয়ের গতি কমাই, শুধু যাতে শান্তি থাকে, সম্পর্ক থাকে, যদিও সেই শান্তিতে প্রেম কমে যায়, উষ্ণতা জমাট বাঁধে।
কল্পনায় কখনো কখনো আবার সেই পুরোনো দৃশ্য তৈরি হয়, সে এসে আমার চুলে মুখ গুঁজে বলছে, ‘চলো কোথাও পালিয়ে যাই’।
আর আমি হাসছি ভয় পেয়ে, আর বলছি, ‘আমি তো কাউকে ফেলে যেতে জানি না,’ তখন সে বলে, ‘আমাকেই নিয়ে যাও তবে। তোমার হাতেই থাকি।’
এই স্মৃতিগুলো আজ একেবারেই বিলাসিতা, বুকের মধ্যে ব্যথা নিয়ে বাঁচার বিলাসিতা। কারণ বাস্তবতা এত কঠিন যে, স্মৃতিই একসময় শেষ অবলম্বন হয়ে টিকে থাকে। কারণ হারিয়ে যাওয়া প্রেমকে কেউ কবর দেয় না। সে বেঁচে থাকে ধুলো জমা বইয়ের পাতায়, চায়ের কাপের ধোঁয়ায়, শাড়ির ভাঁজে, ভুলে যাওয়া গানগুলোর সুরে, আর চোখের কোণে টান খাওয়া নীরবতায়।
‘তবু, আমি তাকে ভালোবাসি’,এটা যতই বলি, অদ্ভুত লাগে। ভালোবাসার চেয়ে রাগ বেশি, ব্যথা বেশি, অভিমান বেশি, তবু শেষ পর্যন্ত ভালোবাসাই জেতে। আমি যদি সাগর হই, সে জোয়ার। আমি যদি আগুন হই, সে ছাই। আমি যদি হেলেন হই, সে এক যোদ্ধা, যে ক্লান্ত হয়ে অস্ত্র নামিয়েছে।
একদিন আমি বললাম, ‘তুমি আগের মতো থাকতে পারো না?’
সে হেসেছিল, দু’ফোঁটা পানি চোখে নিয়ে বলেছিল, ‘আগের মতো? আগের আমি তো বদলে গেছি। তুমি কি আগের তুমি আছো?’
আমি জবাব দিতে পারিনি। কারণ সত্যি। আমিও বদলে গেছি, শুধু স্বীকার করতে শিখিনি।
আমি রান্নাঘরের জানালায় দাঁড়িয়ে ভাবি, হয়তো আমাদের প্রেম ট্রয়। যুদ্ধ হয়েছে। আগুন লেগেছে। এখন শুধু ধোঁয়া। কিন্তু ধোঁয়ার মধ্যেও রোদ ঢোকে। সেই রোদে ছোট্ট একটা আলো থাকে, আশার আলো। হয়তো একদিন ও আবার বলবে, ‘চলো পালিয়ে যাই।’
হয়তো বলবে না। তবু আমি অপেক্ষায় থাকি। কারণ ঢেউ যখন থেমে যায়, তখনো সমুদ্র মরে না।
কখনো হয়তো আমরা আবার প্রথম দিনের মতো হবো। নাও হতে পারি। কিন্তু আমার ভেতরের ট্রয় আজও দাঁড়িয়ে আছে। যুদ্ধ কমেছে, ধোঁয়া আছে, স্বপ্নের ছাই আছে। কিন্তু দেয়াল ভাঙেনি। ভালোবাসার দুর্গ শেষ পর্যন্ত ভাঙা কি এত সহজ? তবুও, এক ধরনের শান্তি আছে এই ক্ষয়ে যাওয়া আকুলতায়, এক ধরনের ধৈর্য আছে এই অসমাপ্ত প্রেমে। কেউ বলে, ‘শেষ হলে শেষ। গল্প এগোয় না।’
আমি বলি, ‘কিছু গল্প কখনও শেষ হয় না। শুধু চরিত্ররা ক্লান্ত হয়।’
এবং হয়তো ও শুধু ক্লান্ত। আর আমি, এখনও জেগে আছি। এখন আমি শুধু ঠায় দাঁড়িয়ে থাকি অপলক চোখে, ঢেউয়ের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে, তবু ভাঙি না, কারণ ভাঙলে তো শেষ হয়ে যাব, আর আমার তো শেষ হওয়ার অনুমতি নেই।
(প্রথম প্রকাশ – প্রতিধ্বনি, ৮ নভেম্বর, ২০২৫)
![]()