জীবনের বাঁকে
সকাল সাড়ে দশটা বাজে। ইচ্ছে করেই দেরিতে বিছানা থেকে উঠেছে লতা। ঘুম ভেঙেছে অনেক আগেই। চোখ বন্ধ করে শুয়েছিল সে। হাসানের সাথে বিয়ে হয়েছে গত সেপ্টেম্বরে। প্রায় সাত মাস হয়েছে। মানুষ হিসেবে মন্দ নয় হাসান। কিন্তু আবেগ-টাবেগ বলতে কিচ্ছু নাই। শুধু হাসান কেন, তার শ্বশুর, শাশুড়ি, ননদ, দেবর, সবাই একই ধাঁচে গড়া। একজন যেন আরেকজনের ফটোকপি। এরা একেকটা রোবট।
এরা কেউ আনন্দ করতে জানে না। এদের মধ্যে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করার কোনো রীতি নাই। এরা জন্মদিন পালন করে না। কাউকে উইশ পর্যন্ত করে না। বিবাহবার্ষিকী পালন তো আরও দূরের কথা। থার্টি ফাস্ট নাইটে ভেবেছিল বেশ মজা করবে। সাড়ে দশটার মধ্যে সবাই যে যার মতো ঘুমাতে চলে গেছে। আজব এক ফ্যামিলি। এদের থিউরি বেশি রাত জাগা যাবে না। বছরের প্রথম দিন খুব ভালো ভাবে শুরু করতে হবে। খুব সকালে উঠতে হবে।
লতা জানালার পর্দাটা একটু ফাঁকা রেখে বিছানায় শুয়ে থেকেই আতশবাজি দেখেছিল। চোখে একসময় পানিও এসে গিয়েছিল। এদের সাথে সারাজীবন কীভাবে কাটাবে সে?
আজ ইচ্ছে করে দেরিতে বিছানা থেকে ওঠার পেছনে একটা জিদ কাজ করেছে লতার। আজ ওর জন্মদিন। রাত বারোটা এক মিনিটে কারও উইশ করার কোনো প্রশ্নই আসে না। এরা তো এগারোটার মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়ে। মোবাইলে একের পর নোটিফিকেশন আসছিল। এমনকি কয়েকজন কলও করেছিল। ইচ্ছে করেই রিসিভ করেনি সে।
কাছের মানুষগুলোই কিছু বলছে না! দূরের মানুষের শুভেচ্ছা নিয়ে কী লাভ? লতার পুরো সন্দেহ হচ্ছিল এই মানুষগুলো আদৌ জানে কি না যে আজ ১২ এপ্রিল তার জন্মদিন! সম্ভবত জানে না। আর জানলেই বা কি আর না জানলেই কি! ওদের এতে কিচ্ছু যায় না।
বিছানা থেকে নামতেই অবাক হয় লতা। হাসানের কথা শোনা যাচ্ছে বাইরে। অফিসে যায়নি সে? হাসান একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকুরি করে। ওর সাপ্তাহিক ছুটি রবিবার। তবে কি হাসান আজকের দিনটা তার সাথে কাটানোর জন্য অফিস ছুটি নিয়েছে? লতা মনে মনে হাসে। কীসব আজব জিনিস নিয়ে ভাবছে সে? এ বাড়িতে আবার জন্মদিন কীসের?
ঘরে ঢুকেই হাসান বলে, দ্রুত নাশতা করে নাও। তোমাকে নিয়ে একটু বাইরে যাব।
লতা বলে, তোমার অফিস নাই?
-না, ছুটি নিয়েছি। তুমি দ্রুত খেয়ে নাও। আমরা বারোটার দিকে বের হবো।
লতা আর কথা না বাড়িয়ে ফ্রেশ হয়ে নাশতার টেবিলে যায়। সবার খাওয়া শেষ। শাশুড়ি এসে বলে, এত দেরি করে উঠলে কেন, মা? শরীর খারাপ নাকি? তোমারও আবার জ্বর আসলো নাকি? তোমার শ্বশুর, হাসান, হাবিব ওদের তো আগেই হয়ে গেছে। লিমা আর আমার চলছে। এখন শুধু তুমিই বাকি আছো! তোমার শরীরে ব্যথা নাই তো?
লতা বলে, না, আম্মা। শরীর খারাপ না। ব্যথাও নাই। এমনিতেই ঘুম ভাঙতে দেরি হয়েছে।
খাওয়া শেষ করে দ্রুত বেডরুমে চলে আসে লতা। শাড়ি পরতে দেখে হাসান বলে, শাড়ি নয়, আজ বরং সালোয়ারকামিজ পরো।
লতা কিছু না বলে সালোয়ারকামিজ পরে নেয়।
বাসা থেকে বের হয়ে গাড়ির দিকে এগোতেই হাসান বলে, গাড়িতে যাব না। আজ আমরা রিকশা করে যাব।
লতা ভাবে, এই কড়া রোদের মধ্যে দুপুরবেলা কোথায় যাবে রিকশা নিয়ে! মুখে বলে, কোথায় যাব আমরা?
হাসান বলে, একটা জায়গায় যাব। দুপুরে ওখানে খাব আমরা।
লতা মনে মনে একটু খুশি হয়। ভাবে, হাসান তাকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যাচ্ছে তার জন্মদিন উদযাপন করতে। যদিও হাসান নিজের মুখে কিছুই বলছে না। বাড়ির সবাই যেহেতু এটা পছন্দ করে না, তাই হয়তো সে এই বুদ্ধি বের করেছে।
কিন্তু আধা ঘণ্টা পর রিকশা যেখানে দাঁড়ায়, তাতে লতার সকালের রাগটা আবার চাঁড়া দিয়ে ওঠে। ভাষানটেক বস্তির পাশেই একটা লম্বা টিনশেড বাসা। দরজায় নক করতেই একজন মহিলা দরজা খুলে দেয়। তার পাশে ছোট্ট একটা বাচ্চা। মহিলার বয়স দেখে মনে হলো, মেয়েটা তার নাতনি হতে পারে।
বাসার ভেতরে ঢুকতেই দম বন্ধ হয়ে আসে লতার। ছোট্ট একটা রুম। মাথা থেকে প্রায় এক হাত ওপরে একটা সিলিং ফ্যান ঘুরছে। ফ্যানের বাতাসের সাথে মনে হয় আগুনের তাপ এসে লাগছে তার চোখেমুখে। তাপের কারণে তার চোখ ছোট হয়ে আসছে।
লতা ভাবছে, এটা কী হাসানের কোনো বিশেষ আত্মীয়ের বাসা? হঠাৎ এখানে কেন খেতে এলো সে? এই গরমের মধ্যে! এখানকার পরিবেশ দেখে তার মনে হচ্ছে না যে সে এখানকার কোনো খাবার খেতে পারবে।
হাসান মহিলাকে জিজ্ঞেস করে, খাবার এসেছে খালা?
মহিলা বলে, হ্যাঁ, বাবা, এসেছে। সব রেডি আছে। পাশের ঘরে সব ব্যবস্থা করেছি। তোমরা গেলেই শুরু করব।
হাসান লতার দিকে চেয়ে বলে, এসো।
লতা পুতুলের মতো হাসানের পিছু নেয়। পাশের ঘরে ঢুকেই অবাক হয়ে যায় সে। বিশাল এক রুম। ওপরে চারটা সিলিং ফ্যান ঘুরছে। এখানে তাপ আরও বেশি। অনেকগুলো বাচ্চা মেয়ে মেলামাইনের প্লেট নিয়ে বসে আছে। প্রত্যেকের পাশেই একটা করে বিরিয়ানির প্যাকেট।
এক পাশে হাসান আর লতার জন্য জায়গা রাখা হয়েছে। ওরা দুজন বসে পড়ে। প্রথমে খাবার নিতে একটু অস্বস্তি লাগলেও মেয়েগুলোর আনন্দ দেখে প্যাকেট খুলে কিছু খাবার প্লেটে নেয়। প্রায় তিরিশজন হবে। প্রায় একই বয়সের।
মহিলা বলে, আরেকটু নাও মা! তুমি কম খেলে ওরা কষ্ট পাবে। এতিম তো! ওদের আবার একটু অভিমান বেশি হয়!
এতিম শব্দটা লতার কান দিয়ে ঢুকে বুক পর্যন্ত চলে যায়। বুকের ভেতর থেকে একটা কান্না ডুকরে বের হয়ে আসে। সে নিজেও তো এতিম। পনের বছর বয়সে বাবা-মা এক্সিডেন্টে মারা যাওয়ার পর থেকে মা-মামির বাসায় এতিমের বড়ো হয়েছে।
নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে কান্নাটা থামাতে পারলেও চোখের পানি বাধা মানে না। চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝরতে থাকে। কয়েকবার নাক টেনে সামাল দেওয়ার চেষ্টা করে।
মহিলা বলে, ঝাল লেগেছে মা? একটু পানি খাও।
লতা এই প্রথম উপলব্ধি করে তার আর গরম লাগছে না। চোখ দিয়ে পানি ঝরলেও খেয়ে যাচ্ছে সে।
হাসান পাশে থেকে লতার পিঠে রাখে। হাসানের স্পর্শ পেয়ে আর নিজেকে সামাল দিতে পারে না সে। পাশের রুমে উঠে এসে শব্দ করে কাঁদতে থাকে।
হাসানও এসে বসে তার পাশে। কিছুক্ষণ পর মহিলাও আসে। বলে, তুমি কি আমার কথায় কষ্ট পেয়েছ মা? তুমি আবার আমার ওপর রাগ করো না মা! তোমাদের মতো মানুষের দানেই তো আমার এই এতিমখানা চলে।
লতা একটু স্বাভাবিক হয়ে বলে, না খালা, রাগ করব কেন? আমি ভুলেই গিয়েছিলাম আমিও একজন এতিম। ওদের এখানে এসে মনে পড়ল তো তাই একটু ইমোশনাল হয়ে পড়েছিলাম।
এতিমখানায় আরও ঘণ্টাখানেক সময় থেকে বাসার পথ ধরে ওরা।
ফেরার পথে রিকশায় বসে লতা ভাবে, তার পাশে বসা আবেগহীন মানুষটার কথা। আসলে সে তার আবেগ প্রকাশ করে না। কিন্তু তার ভেতরটা আবেগ দিয়ে ভর্তি।
লতা বলে, আমাকে একটু ধরে রাখবে? মনে হচ্ছে, পড়ে যাব রিকশা থেকে।
হাসান মুখে কিছু না বলে লতার পিঠের পেছনে একটা হাত দিয়ে ধরে রাখে তাকে।
বাসায় ঢুকেই অবাক হয় লতা। মামা-মামি এসেছে। বাসায় বেশ ভুরিভোজের আয়োজন চলছে। শাশুড়ি আর ননদ শরীরে জ্বর নিয়েই কাজ করে চলেছে।
রাতের খাওয়া শেষ করে মামা-মামিকে বিদায় দিতে দিতে প্রায় দশটা বেজে যায়। ক্লান্ত শরীর নিয়ে বিছানায় শুয়ে পড়ে লতা। হাসান ওপাশ ফিতে শুয়ে আছে।
এতিম মেয়েটার সব অভিমান মুছে দিয়েছে ওরা। হয়তো মুখে কেউ উইশ করেনি, কিন্তু তাদের ভালোবাসায় তার মন ভরে গেছে।
লতার চোখ আবার পানিতে ভরে গেছে। চোখ ব্যথা করছে। কিন্তু তারপরও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে সে। চোখ থেকে অঝোর ধারায় পানি ঝরছে। বালিশ ভিজে যাচ্ছে। আবেগহীন এই মানুষগুলো এত ভালভাসে তাকে। এদের এত ভালোবাসার প্রতিদান কীভাবে দেবে সে?
হাসান এপাশ ফিরে লতাকে বুকের মধ্যে নিয়ে বলে, অনেক কেঁদেছ, আর না। লতার কান্নার আওয়াজ আরও বাড়তে থাকে। এতিম মেয়েটার সব অভিমান মুছে যাবে আজ।
১৩ এপ্রিল ২০২৫