বিপ্রতীপ
১
‘স্যার, আগামীকাল বিকালে আমাদের বাসায় আসবেন। প্লীজ। আপনি আমার খুবই প্রিয় একজন মানুষ, স্যার। কাল আমার জন্মদিন। জন্মদিনে আপনার সাথে কিছুটা সময় কাটাতে পারলে তা আমার জন্য অনেক বড় পাওয়া হবে। ঠিক সাড়ে চারটায় আসবেন, স্যার। বাসায় আমি একা থাকব। আমাকে এক ঘণ্টা সময় দেবেন। স্যার প্লীজ, না করবেন না। প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ, প্লীজ।’
কথাগুলো গড়গড় করে বলে থামল রীতু। তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতে একটা ছোট্ট একটা চিরকুট।
‘স্যার, এখানে আমার ঠিকানা আছে। আসবেন কিন্তু, প্লীজ। আমি আপনার অপেক্ষায় থাকব।’
শেখর আহমেদ চিরকুটটা হাতে নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে নিলেন। রীতু, ১৭৮/বি, দিলু রোড, মগবাজার। নিচে মোবাইল নম্বর লেখা। মেয়েটার দিকে তাকালেন। বললেন, ‘আমি কাছেই থাকি। নিউ বেইলি রোডে। সময় পেলে অবশ্যই আসব।’
রীতুর চোখেমুখে খেলে যাওয়া আনন্দের ঢেউ থামার আগেই শেখর আহমেদ গাড়িতে উঠে বসলেন। গাড়ির কালো গ্লাসের ভেতর দিয়ে আরেকবার দেখলেন রীতুকে। হাল্কা নীল রঙের একটা শাড়ি পড়েছে। মেয়েটা অদ্ভুত সুন্দর। ‘ইশ! যদি তিরিশ বছর আগে এ পৃথিবীতে জন্ম নিতে পারতেন! এই মেয়েটার হাতে হাত রেখে ঘুরতে পারতেন!’
‘স্যার, গাড়ি ছাড়ব?’
ড্রাইভারের কথায় সম্বিৎ ফিরে পান শেখর আহমেদ। অস্বস্তি নিয়ে তাড়াতাড়ি বলেন, ‘হ্যাঁ, চলো।’
গাড়ি বামে বাঁক নিতেই আবার দেখার চেষ্টা করেন রীতুকে। দেখে মনে হলো, তার গাড়ির দিকে চেয়ে এখনও দাঁড়িয়ে আছে একই জায়গায়। রীতু কি বুঝতে পেরেছে যে তিনি তাকে এখনও দেখছেন।
‘স্যার, মেয়েটা কি ফেল করছে নাকি?’ ড্রাইভারের কথায় ঘাড় সোজা করে সামনে তাকান শেখর আহমেদ।
‘আরে না, তেমন কিছু না! কিন্তু হঠাৎ একথা জিজ্ঞেস করলে কেন?’
‘প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে ছিলো। ব্যাপার সিরিয়াস না হলে কেউ এতক্ষণ অপেক্ষা করে?’
শেখর আহমেদ আবারও বললেন, ‘না, তেমন কিছু না।’
কিন্তু মুখে এমন কথা বললেও তাঁর নিজের কাছে ব্যাপারটাকে বেশ সিরিয়াস মনে হলো। বিশেষ করে যখন জানতে পারলেন যে, রীতু তাঁর সাথে কথা বলার জন্য এক ঘণ্টা ধরে দাঁড়িয়েছিল। তিনি মানিব্যাগের একটা পকেট থেকে আরও কয়েকটা চিরকুট বের করলেন। সবগুলোতেই একই ঠিকানা লেখা। আজকের চিরকুটসহ মোট চারটা। সেগুলো আবার মানিব্যাগে ভরলেন।
শেখর আহমেদ ভাল করেই চেনেন রীতুকে। তাঁকে একটু একা পেলেই কথা বলার চেষ্টা করে মেয়েটা। গত কয়েক মাস ধরেই চলছে এরকম। তিনি গাড়িতে ওঠার ঠিক আগ মুহূর্তে কোথা থেকে যেন হাজির হয়ে যায় মেয়েটা। তার পর যে-কোনো একটা ইভেন্টের কথা বলে বাসায় যাবার আমন্ত্রণ। তবে আজই প্রথম এল একটা বাক্য। ‘বাসায় আমি একা থাকব।’ শেখর আহমেদ সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু এই বাক্যটা নিয়েই ভাবছেন। এইটা কেন বলতে হলো তাকে? রীতুর বাসায় যাওয়ার সাথে তার একা থাকার কী সম্পর্ক? সে একা থাকলে কী হবে? কী ঘটতে পারে?
যা ঘটতে পারে তা নিয়ে কিছুক্ষণ ভাবতেই ঘেমে উঠলেন শেখর আহমেদ। এটা একটা ট্র্যাপ হতে পারে। গত সপ্তাহেও তো পেপারে দেখলেন, কোন একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রী এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে শ্লীলতাহানির অভিযোগ এনেছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে না নেওয়ায় শুরু হয় ছাত্রছাত্রীদের মিছিল, মিটিং, একটানা অনশন ও অবরোধ। পরে পরিস্থিতি শান্ত করতে তড়িঘড়ি করেই ঐ শিক্ষককে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে।
শেখর আহমেদ প্রায় পঁচিশ বছর হলো শিক্ষকতা করছেন। এর আগে তিনি কখনও এরকম পরিস্থিতির মুখোমুখি হননি। নিজের আচরণে নিজেই অবাক হচ্ছেন তিনি। রীতুকে নিয়ে এভাবে ভাবছেন কেন? তিনি কি মেয়েটার প্রতি দুর্বল ? নাকি এক অমোঘ নিয়তি তাঁকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক ভয়াবহ ঘটনার দিকে। যে ঘটনার শেষে অপেক্ষা করছে এক ভয়াবহ পরিণতি, যাতে তাঁর সুনাম, সামাজিক অবস্থান সবকিছু ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
শেখর আহমেদ মাথাটা একটু কাত করে স্ক্রিনে এসির তাপমাত্রা দেখলেন। ২২ ডিগ্রী। একবার ভাবলেন ড্রাইভারকে তাপমাত্রা আর একটু কমাতে বলবেন। কিন্তু বলতে গিয়েও থেমে গেলেন। কোনো লাভ হবেনা। কারণ গরমটা আসছে তাঁর ভেতর থেকে। ওখানে ঠাণ্ডা হওয়াটা জরুরি । শেখর আহমেদ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি মেয়েটার বাসায় কোনোভাবেই যাবেন না।
২
নিজের ঘরে গিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন শেখর আহমেদ। এই কাজটা তাঁর স্বভাববিরুদ্ধ। তিনি কখনই এভাবে আয়নার সামনে দাঁড়ান না। বিশেষ করে নিজের বয়স পরিমাপের জন্য। মাথার সাদাকালো চুল, কুঁচকানো চামড়া, সব মিলিয়ে আয়নায় তিনি যা পেলেন তাতে তাঁর কোনোভাবেই মনে হলো না যে, মেয়েটা তাঁকে পছন্দ করে বাসায় যেতে বলেছে। চেহারার সে ভাব তিনি অনেক আগেই হারিয়েছেন।
চল্লিশের পরে নাকি পুরুষমানুষের ভীমরতি ধরে। নতুন করে আবার প্রেমে পড়তে চায়। কিন্তু শেখর আহমেদ তো চল্লিশ পেরিয়েছেন অনেক আগেই। আসল জন্মতারিখ ধরে হিসেব করলে তিনি পঞ্চাশও পার করেছেন বছর দুয়েক আগে। বয়স যাই হোক, এই যে তিনি একটা মেয়েকে নিয়ে ভাবছেন, তার বিশেষ আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে তার বাসায় যেতে চাইছেন, এ বিষয়গুলো শেখর আহমেদকে অন্যরকম একটা আনন্দ দিচ্ছে। কিছু জয় করার আনন্দ। তিনি রীতুকে জয় করতে পেরেছেন, যা অনেক যুবকের কাছেই ঈর্ষণীয় বিষয় হতে পারে।
শেখর আহমেদ রীতুকে নিয়ে দিনের বাকি সময়টা ভাবলেন। রাতের ঘুমটাও অন্যদিনের তুলনায় একটু দেরিতে এল। পরদিন সকালে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু আগেই ঘুম ভেঙে গেল। নাশতার টেবিলে বসে মনে হলো বাসার সবাই যেন তাঁকেই দেখছে। তাঁর মধ্যে কি খুব বেশি পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে? মোটেও তা নয়। অন্যরা যেরকম ছিল, সেরকমই আছে। শেখর আহমেদই বরং নিজেকে নিয়ে, আশেপাশের মানুষকে নিয়ে, রীতুকে নিয়ে একটু অন্যভাবে ভাবছেন। সেকারণেই তাঁর সবকিছুতেই যেন একটা পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। একটু হলেও আলাদা মনে হচ্ছে।
এই আলাদা ভাবটা ভালোই উপভোগ করছেন শেখর আহমেদ। অন্যরকম ভালোলাগা কাজ করছে। মাত্র একটা ঘণ্টাই তো চেয়েছে মেয়েটা। অনেকদিন ধরেই তো সে এটা চাইছে। ছোট্ট একটা আবদার। তিনি আজ যেভাবে রীতুকে নিয়ে ভাবছেন, সে তো তাঁকে নিয়ে প্রতিদিনই ভাবে। তাঁর ক্লাস কখন শেষ হবে, কোথায় দাঁড়ালে তাঁর সাথে দেখা হবে, কোথায় তাঁর গাড়ি অপেক্ষা করে, কী কথা বলবে তাঁকে, এরকম অজস্র বিষয় নিয়ে রীতুর মনে তাঁর জন্য একটা আলাদা জগত তৈরি হয়েছে। সে জগতে তাঁর কোনো অংশীদার নেই। তিনি সেখানে একা।
শেখর আহমেদ সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি রীতুদের বাসায় যাবেন। ঠিক সাড়ে তিনটায় বাসা থেকে বের হবেন। তিনি মেয়েটাকে আর হতাশায় পোড়াতে চান না। রিকশা করে যাবেন। তিনি তাঁর ড্রাইভারের থেকে বিষয়টা আড়ালে রাখতে চাইছেন।
৩
হঠাৎ করেই আকাশে মেঘ জমতে শুরু করেছে। ঘন, কালো মেঘ। সাথে শীতল বাতাস বইছে। কেমন যেন একটা অস্বাভাবিক পরিবেশ। নিজেকেও কিছুতেই স্বাভাবিক মনে হচ্ছে না শেখর আহমেদের। রিকশা থেকে নেমে হেঁটে হেঁটে যখন রীতুদের বাসাটা খুঁজে পেলেন, তখন তাঁর মন জুড়ে একটা অস্থিরতা কাজ করছিল। কলিংবেল এ চাপ দিতে গিয়েও দিলেন না। সিদ্ধান্ত নিলেন, ফিরে যাবেন। তা আর হলো না। দোতলার বারান্দা থেকে কে যেন চিৎকার করে উঠল, ‘স্যার, একটু দাঁড়ান আমি আসছি।’
বারান্দায় যাকে দেখলেন সে আর যেই হোক রীতু না, এ ব্যাপারে তিনি শতভাগ নিশ্চিত। রীতুর চেহারা গতকাল থেকে যতবার মনে করেছেন তাতে মেয়েটার চেহারা ভুলে যাওয়ার কোনো প্রশ্নই আসে না। তবে ব্যাপারটা তাকে একটু সাহস যোগালো। বাসায় রীতু ছাড়া আরও কেউ আছে। রীতুর একা থাকা এবং সে সম্পর্কিত নানা বিষয়ে তাঁর যে বিবিধ ভাবনা ছিল, সেগুলো থেকে তাঁর আপাতত মুক্তি মিলল। তিনি অনেকটাই স্বাভাবিক হয়ে দরজা খোলার অপেক্ষায় থাকলেন। বাসার পকেট গেইট খুলতেই তিনি যাকে দেখতে পেলেন সেই মেয়েটা রীতুর থেকে বয়সে বড় হবে। তবে তার পরনে হাল্কা নীল রঙের একটা শাড়ি যেরকমটা রীতু পরেছিল আগেরদিন। বড় বোন হতে পারে। বান্ধবীও হতে পারে। এমনও হতে পারে, রীতু ওর বান্ধবীর সাথে বাজি ধরেছে তাঁকে বাসায় আনার বিষয়ে। ওরা কি তাঁকে নিয়ে মজা করছে? মেয়েটার চোখের দিকে তাকিয়ে তা মনে হলো না। সে চোখে বিস্ময়, আনন্দ, বেদনা সবকিছুর মিশেলে একটা দুর্বোধ্য অভিব্যক্তি, যা থেকে চিরচেনা যে-কোনো একটা ভাবকে পৃথক করা রীতিমত দুঃসাধ্য ব্যাপার।
‘স্যার, ভেতরে আসেন। রীতু একটু বাইরে গেছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসবে।’
শেখর আহমেদ ভাবলেন, এসেই যখন পড়েছেন এর শেষ দেখেই যাবেন। যদি তাঁকে নিয়ে কোনো মজা করতে চায় ওরা, করুক। তিনিও দেখতে চান ওরা কত নিচে নামতে পারে।
মেয়েটার পরিচয় জানতে গিয়েও থেমে গেলেন। কী লাভ জিজ্ঞাসা করে! নিশ্চিত মিথ্যা বলবে। মেয়েটার পেছনে পেছনে বাসার মূল ফটক থেকে একটু হেঁটে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে গেলেন। দরজা পেরোতেই পরিপাটি একটা বসার ঘর। শেখর আহমেদ সোফায় বসলেন।
‘কী চা দেবো, স্যার?’
‘চিনি ছাড়া একটু লেবুর রস দিয়ে। আদা দিতে পারো।’
বাসায় সুনসান নীরবতা। কিন্তু সে নীরবতা স্থায়ী হলো না। বৃষ্টি এল। ঝমঝম বৃষ্টি। শব্দে কানা তালা লাগার মতো অবস্থা। শেখর আহমেদ চায়ে চুমুক দিচ্ছেন আর ভাবছেন এখানে তিনি কেন এলেন।
৪
বারান্দায় হাল্কা বৃষ্টির ঝাপটা আসা শুরু হয়েছে। শুকাতে দেওয়া কাপড়গুলো রশি থেকে নামিয়ে সেগুলো ভেতরে রেখে এসে বারান্দায় দাঁড়ায়। বৃষ্টি বাড়ছে। আশা বৃষ্টিতে ভিজছে।
শেখর আহমেদ চা খেতে খেতে মেয়েটার কাণ্ড দেখছেন। বৃষ্টির ফোঁটা শরীরে পড়লে শিহরণ জাগে, তিনি ভালো করেই জানেন। কিন্তু কাউকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেখলে শরীর যে এতটা শিহরিত হতে পারে তা তাঁর জানা ছিল না। বৃষ্টি মানুষের শরীরকে কতটা মোহময় করে তুলতে পারে, সেটাও তিনি আজ প্রথম দেখলেন। তাঁর দৃষ্টি আটকে গেছে হাল্কা নীল শাড়িতে জড়ানো ভেজা শরীরটার দিকে। চায়ে চুমুক দিচ্ছেন। কিন্তু তাঁর মনে হয়, চা নয়, তিনি বরং ঐ শরীর চুয়ানো বৃষ্টির পানি গিলছেন।
আশা পেছন দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারছে স্যার তার দিকেই চেয়ে আছে। একবার ভাবে, যে পাতলা শাড়ি তার! একটা এক্সট্রা ওড়না পরা উচিত ছিল। পরে ভাবে, উনি দেখুক ভালো করে। বুঝুক মেয়েটা অনেক বড় হয়েছে। বিয়ে দিতে হবে তাকে।
আশা রীতুদের গ্রামের মেয়ে। আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। বাবা-মা কেউ নেই। মা মারা গিয়েছে শৈশবেই। কলেজের গণ্ডি না পেরোতেই বাবা মারা যায়। তার পর থেকে রীতুদের বাসায়। প্রায় দশ বছর পেরিয়ে গেছে এ বাসায়। প্রধান কাজ রীতুর সাহচর্য দেওয়া। রীতুর বাবা, মা দুজনেই চাকুরি করায় রীতুর কথা ভেবেই এই ব্যবস্থা। রীতু আশাকে বড় বোনের মতই করে। একদিন আশার কাছে তার বাবার একটা ছবি দেখে অবাক হয়ে যায় রীতু।
‘আমাদের একজন স্যার আছেন। শেখর আহমেদ। একদম তোমার বাবার মতো দেখতে। তুমি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করবে না। মানুষের চেহারায় এতো মিল থাকতে পারে!’
আশা একবার রীতুর সাথে ভার্সিটি গিয়ে গাড়িতে বসেই দেখে শেখর আহমেদকে। তার পর থেকেই তার বায়না, ‘একদিন বাসায় নিয়ে আসো স্যারকে। ওনার সাথে বসে গল্প করব। খালা-খালু যেদিন বাইরে থাকবে, এরকম একটা দিনে।’
‘ঠিক আছে, চেষ্টা করব।’
‘তোমারও কিন্তু বাসায় থাকা যাবে না।’
রীতু মুচকি হেসে বলে, ‘ঠিক আছে, তাও মেনে নিলাম।’
এর পর থেকে কয়েকবার চেষ্টা করেছে রীতু। স্যারকে একটা চিরকুটে ঠিকানা দিয়ে বাসায় আসার অনুরোধ করেছে। প্রতিবার ঘণ্টার পর ঘণ্টা বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকেছে আশা। স্যার যদি বাসা না চিনতে পেরে ফিরে যায়। কিন্তু প্রতিবারই হতাশ হয়েছে সে। আজও দুপুরের খাবার খেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়েছিল সে। মেঘলা আকাশ ভয় পাইয়ে দিয়েছিল তাকে। বৃষ্টি এলে হয়তো স্যার আর আসতো না। বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনে মনে দোয়া করছিল যাতে বৃষ্টি না আসে। আর সেই আশাই এখন বৃষ্টিতে ভিজছে মনের আনন্দে। ভাবছে, বৃষ্টি পড়ুক আরো কয়েক ঘণ্টা। রীতু যাতে না ফিরতে পারে। স্যার যাতে বাসা থেকে না বেরোতে পারে। আজ অনেক কাছে থেকে দেখেছে তাঁকে। একদম বাবার মতো। সেই চোখ। সেই নাক। সেই সাদাকালো চুল।
আশার হঠাৎ মনে পড়ে সালাম করা হয়নি স্যারকে।
৫
আশা বারান্দা থেকে ফিরে ভেজা শরীরেই শেখর আহমেদের সামনে দাঁড়ায়। চা খাওয়া শেষের পথে। আশা তাঁর হাত ধরে সোফা থেকে তুলে আনে ডাইনিং স্পেসের ফাঁকা একটা জায়গায়। মেয়েটা কী করতে পারে তাই ভাবছেন তিনি। ভেজা শাড়িটা লেপটে গেছে ওর শরীরের সাথে। সে তাঁর এত কাছে যে শরীর থেকে ভেসে আসা একটা মিষ্টি গন্ধ তাঁকে পাগল করে তুলছে। মেয়েটা কী চায়? নিজেকে সামলে রাখার চেষ্টা করছেন শেখর আহমেদ। তাঁর হৃদস্পন্দন বলছে তাঁর ভেতরে একটা ঝড় বয়ে যাচ্ছে। আগ বাড়িয়ে নিজে কিছু না করে তিনি চাচ্ছেন মেয়েটাই এগিয়ে আসুক। তিনি শুধু সায় দেবেন তার কাজে।
মেয়েটা আরও কাছে এসেছে। তার প্রতিটা শ্বাসপ্রশ্বাসে বুকের ওঠানামা টের পাচ্ছেন শেখর আহমেদ। হাতদুটো এখনও তার হাতে ধরা। মেয়েটা হঠাৎ তাঁর হাত ছেড়ে দিয়ে পায়ের কাছে বসে পড়ে। শেখর আহমেদের পুরো শরীরে শিহরণ খেলতে শুরু করেছে।
মেয়েটা তাঁর পায়ে হাত দিয়ে সালাম করে। কিছুক্ষণ ওভাবেই বসে থাকে। তার পর তাঁর শরীরের সাথে শরীর ঘেঁষে উঠে দাঁড়ায়। শেখর আহমেদ তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সেই হাত ঘাড়ে নামে। একসময় পিঠে। তারপর মেয়েটার সুগঠিত শরীরটাকে দু’হাতে জড়িয়ে ধরেন। আশা ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে না। বরং সেও দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে শেখর আহমেদকে। তার মনে হয়, কতদিন পরে বাবার বুকে ঠাই পেয়েছে। তার চোখে অশ্রু নেমে আসে। মুখ থেকে অস্ফুট স্বরে ভেসে আসে, ‘বাজান, বাজান’।
শেখর আহমেদের ভেতরের পশু পুরোপুরি জেগে উঠার আগেই তাঁর কানে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে ‘বাজান, বাজান’। সম্বিৎ ফিরে পেয়ে এক ঝটকায় আশাকে দূরে ঠেলে দিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসেন। পেছন থেকে আশা তখনও ডেকে চলেছে, ‘বাজান, বাজান’ ।
বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। শেখর আহমেদ বৃষ্টির মধ্যেই নেমে এলেন রাস্তায়। একমনে হেঁটে চলেছেন। কোন দিকে যে যাচ্ছেন, তা তিনি নিজেও জানেন না। বৃষ্টিতে ভিজে একাকার। প্রচণ্ড শব্দে বাজ পড়ল কোথাও। খুব কাছে। শেখর আহমেদের মনে হলো, আরও কাছে পড়ার দরকার ছিল। একদম তাঁর মাথার উপর। বৃষ্টি তাঁর মনের পঙ্কিলতাকে ধুয়ে মুছে দূর করতে পারছে না কিছুতেই।
(প্রথম প্রকাশ- পিদিম, প্রথম সংখ্যা, অক্টোবর ২০২২)