শেষ চিঠি
নীলা,
It was a dream, still a dream. তারপরও অনেক কথা থেকে যায়। অ-নে-ক কথা। শুষ্ক শীতের মিষ্টি সকালে যে চোখে চোখ রেখে স্বপ্ন দেখেছিলাম, সে চোখ ছিল নীল সাগরের মতই গভীর। প্রথমে বুঝতে পারিনি। যখন বুঝতে পারলাম তখন শুধু নোনতা স্বাদ। আমার চোখেও যে এত বিশাল এক সমুদ্র লুকিয়ে ছিল ভাবিনি কখনও। তোমার কারণেই সে সমুদ্র আবিষ্কার করতে পেরেছিলাম। সে জন্য তোমাকে ধন্যবাদ দেয়া হয়নি। আজকের এ ছোট্ট চিঠিটা শুধু ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্যই লেখা। ভালো থেকো।
ইতি-
হারিয়ে যাওয়া আমি।
পুনশ্চঃ
তুমি আমার জীবনটাকে এভাবে পাল্টে দিয়েছ; তাই তোমাকে এত ক্ষুদ্র চিঠি লেখাটা মানায় না। আমার জীবনে দেখা তুমিই প্রথম মানুষ, যে শরতের জ্যোৎস্নাভরা রাতে কালবৈশাখীর তাণ্ডবের প্রতীক্ষায় উন্মুখ হয়ে বসে থাকতে পারে – গ্রীষ্মের দাবদাহে উত্তপ্ত বক্ষে দু’ফোঁটা বৃষ্টি ঝরতেই যে আবারও সূর্যের প্রার্থনা করে। দূরে যেতে বলে কাছে টানে নির্দ্বিধায় – কাছে আসতে বলে যে দু’জনের মাঝে নির্ভেজাল কংক্রিটের দেয়াল গেঁথে দেয়। তোমার এ দ্বিমুখী চরিত্রকে প্রথম প্রথম আমি প্রচণ্ড ঘৃণা করতাম। এখন করি না। কারণ আমি নিজেও এরূপ চরম বৈপরীত্যকে আয়ত্ত করে ফেলেছি। শুনেছি তুমি বিয়ে করেছ। এসো না তোমার সংসার ছেড়ে আমার কাছে। দু’জনে আবার নতুনভাবে জীবন গড়ি। আসবে? আমি কিন্তু তোমাকে ভালবাসতে পারব না। এক সাথে খাব। এক সাথে বেড়াব। এক বিছানায় ঘুমাব। যান্ত্রিকতা থাকবে। জৈবিকতা থাকবে। শুধু আবেগ থাকবে না – ভালবাসা থাকবে না। এসো। এটা তো তোমার কথা। আমি আগে এভাবে ভাবতে পারতাম না। এখন পারি। এ এক অদ্ভুত ক্ষমতা। আর তোমার জন্যই এমন বিশেষ ক্ষমতার অধিকারী হতে পেরেছি। তোমাকে আবারও ধন্যবাদ।
তোমার কি মনে পড়ে না সেদিনের কথা যেদিন আমার কান্নাগুলোকে কালো কালিতে সাজিয়ে নীল মলাটের ডায়েরীতে তোমার হাতে তুলে দিয়েছিলাম। সপ্তাহখানেক পরে তুমি ডায়েরীটা ফিরিয়ে দিয়ে বলেছিলে, এটা কাছে রেখে তোমার কান্না আমি কাঁদব কেন? গত চার বছরের প্রতিটা মুহূর্তে তোমাকে লিখতে মন চেয়েছে। কিন্তু তুমি যদি চিঠি ফেরত দিয়ে দুঃখটা আরও বাড়িয়ে দাও এই ভয়ে লিখতে সাহস করিনি। পত্রিকায় লিখলাম। হাজার হাজার কপি ছাপা হবে। হাজার হাজার চিঠি। কয়টা ফেরত দিতে পারবে তুমি?
অনেকদিন পর তোমাকে লিখতে গিয়ে কয়েকবার কাঁদতে হয়েছে আমাকে। ভালোবাসার এমন এক বীজ বপন করেছিলে আমার মধ্যে যেটা সময়ের সাথে সাথে এক মহীরুহ হয়ে উঠেছে। শাখাপ্রশাখা সব কেটে ফেলেছি। পত্র-পল্লব সব ঝরে পড়েছে। কিন্তু শেকড়টা উপড়ে ফেলতে পারিনি আজও। এ শেকড়ের কারণেই মাঝে মাঝে মনে পড়ে তোমাকে – মনে পড়ে কাউকে ভালোবেসে ছিলাম – স্বপ্ন দেখেছিলাম ঘর বাঁধার – অনুরোধ করেছিলাম কাছে আসতে – ভালবাসতে। চিঠির শেষে একটা অনুরোধ। আশা করছি এ শেষ অনুরোধটুকু তুমি রাখবে। কথা দাও লক্ষীটি, এ চিঠি তুমি একবারের বেশি পড়বে না। আর পড়া শেষ করে একদম কাঁদতে পারবে না। আমাদের একান্ত বিষয়গুলো আজ উন্মুক্ত করে দিলাম। বলতে পার তোমার উপর প্রতিশোধ নিলাম। তাই আমার জন্য চোখের জল ফেলা তোমার সাজে না। চিঠিটা লিখতে গিয়ে পুরাতন শেকড় থেকে আবারও একটা চারাগাছ বের হয়েছে। বিশ্বাস কর, এ গাছটাকে মরতে দেব না কোনোদিন। অন্তত যতদিন চোখের সাগরে পানি থাকবে ততদিন থাকবে ভালোবাসার এ শেষ চিহ্নটুকু।