মার্জিন
১
আজগর আলী মাস্টার আগেই শুনেছিলেন তাঁর ছাত্র শাহীন চৌধুরী ঢাকা শহরে বড়ো বাড়ি করেছে। কিন্তু যাদের কাছে বিষয়টা শুনেছেন তারা ভুল বলেছে। শুধু বাড়ি বললে ভুল বলা হবে, এ যে একটা প্রাসাদ! ঘাড় বাঁকিয়ে দশ তলা বিশাল বাড়িটার দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে তাঁর চোখে একসময় ক্লান্তি নামে। ধীরে ধীরে ঝাপসা হয়ে আসে দুই চোখ। হাত দিয়ে চোখে একটু ঘষা দিয়ে হাতের কাগজে লেখা বাড়ির নম্বরের সাথে আরেকবার মিলিয়ে দেখেন। ৯৫/৩, লেক সার্কাস, কলা বাগান। সব ঠিক আছে।
বাড়ির ঠিকানায় সবকিছু ঠিকঠাক থাকলেও আজগর আলী মাস্টারের নিজেরই কোথাও একটা সমস্যা আছে। কলিংবেল-এ চাপ দিতে গিয়ে রীতিমত ঘামছেন তিনি। যাকে দেখে স্কুলের ছেলেমেয়েরা এখনও ভয়ে কাঁপে, সেই আজগর আলী কাঁপছেন তাঁর এক ছাত্রের বাসার সামনে দাঁড়িয়ে। শুধু হাত ও হাতের আঙুল নয়, তাঁর পা দুটোও কাঁপছে।
অথচ কী দোর্দণ্ড প্রতাপ তাঁর ডেপুইল ও আশপাশের দশ গ্রামে। তাঁর নামে অনেক গল্প প্রচলিত আছে। তিনি একবার এক ছাত্রকে মারতে মারতে স্কুল থেকে তার বাড়িতে নিয়ে গিয়ে তার বাবার কাছে নালিশ দিয়েছিলেন। ছাত্রের বাবা আজগর আলী মাস্টারের এরূপ আচরণে তাঁর প্রতি যারপরনাই সন্তুষ্ট হয়ে তাঁকে ঐদিন দুপুরের খাবার না খেয়ে আসতে দেননি। আরেকবার তিনি এক ছাত্রকে পেটাতে পেটাতে তাঁর প্রিয় ছাতাটা ভেঙে ফেলেছিলেন। ঐ ছাত্রের বাবা খুশি হয়ে পরের দিন আজগর আলী মাস্টারের জন্য অবিকল একটা নতুন ছাতা উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। জনশ্রুতি আছে, স্কুলের পেছনে যে বাঁশঝাড় আছে, তাতে কখনও কঞ্চি পাওয়া যেত না। ছাত্রছাত্রীরা তাদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনায় রেখে নিয়মিত কঞ্চি নিধনের অভিযান পরিচালনা করত।
এত গেল আজগর আলী মাস্টারের হাতের শাসন। তাঁর মুখের শাসন ছিল আরও ভয়াবহ। তাঁর বহুল ব্যবহৃত শব্দমালা ছিল এরকম, “কান ধরে এক টান দিয়ে জানালার বাইরে ফেলে দেবো,” “এক আছাড় দিয়ে পেটের নাড়ীভুঁড়ি বের করে দেবো,” “কান ধরে একবার ছাদের সাথে বাড়ি দেবো, আরেকবার মেঝের সাথে” ইত্যাদি। তাঁর কথা শুনেই অনেকের পেটের ভেতরে থাকা ভাত পর্যন্ত শক্ত হয়ে যেত। তবে আজগর আলী মাস্টারের একটা বিশেষত্ব ছিল। তিনি পড়াশোনা না পারার কারণে কমই মারতেন বা বকা দিতেন। তাঁর মারপিট আর বকাঝকার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মার্জিন। খাতায় মার্জিন না টানলে মার খেতেই হবে। তাঁর একটাই কথা, “খাতা তোদের বাবার টাকায় কেনা, ঠিক আছে। কিন্তু ঐ খাতায় আমার একটা আলাদা জায়গা আছে। মার্জিন। এই মার্জিন তোদের টানতেই হবে। নাহলে আমি খাতায় নম্বর দেবো কোথায়? আমার কোনো মন্তব্য লিখতে মন চাইলে লিখব কোথায়?”
অনেককেই বলতে শোনা যায় যে, স্কুল থেকে অবসর নেয়ার পর তিনি তাঁর এই প্রভাব-প্রতিপত্তি হারিয়ে ফেলার ভয়ে এক সপ্তাহের মাথায় গ্রামে নাইট-স্কুল খুলেছিলেন। সব বয়সীদের জন্য। কিন্তু বয়সে ছোট হোক আর বড় হোক, মারপিট আর বকা দেওয়ার সময় কোন বাছবিচার ছিল না তাঁর। বলাই বাহুল্য যে, তিনি এই নাইট-স্কুলের মাধ্যমেই গত প্রায় এক দশক ধরে অত্র এলাকায় তাঁর তথাকথিত ত্রাসের রাজত্ব এখনও টিকিয়ে রেখেছেন।
ডেপুইল গ্রামের ত্রাস আজগর আলী মাস্টার তাঁর ছাত্র শাহীন চৌধুরীর বাড়ির সামনে ভয়ে চুপসে আছেন। মারপিট আর ধমক দিয়ে ক্লাসের সব বাচ্চাকে বাগে আনতে পারলেও একজন ছিল ব্যতিক্রম। শাহীন চৌধুরী। মেম্বার সাহেবের একমাত্র ছেলে। মেম্বার সাহেব জমির আইলগুলোকে ছাঁটতে ছাঁটতে এমন অবস্থায় নিয়ে যান যে তার ওপর দিয়ে হাঁটার কোনো উপায় থাকে না। তার কথা জায়গা ফেলে রেখে কী লাভ! পিতার যোগ্য উত্তরসূরি হিসেবে শাহীন ছোটোবেলা থেকেই বিশেষ খ্যাতি অর্জন করে ফেলেছিল। তাকে দিয়ে কখনও খাতায় মার্জিন টানাতে পারেননি আজগর আলী মাস্টার। নিয়মিত মারপিট আর বকাঝকা হজম করার পরও তার একটাই কথা, খাতায় মার্জিন টানা মানেই কাগজের অপচয়।
শাহীন চৌধুরী এখনও তার আগের অভ্যাস ধরে রেখেছে। অন্তত তার বাড়ি দেখেই তা বোঝা যায়। আশপাশের বাসাগুলো ফুটপাত থেকে একটু দূরে। বাসার সামনে বেশ খানিকটা ফাঁকা জায়গা। ঠিক যেন খাতায় রাখা মার্জিনের মতো। কিন্তু শাহীন চৌধুরী মার্জিনের তোয়াক্কা করেনি। ফুটপাত ঘেঁষা বাড়িটা দোতলা থেকে মোটা হয়ে ফুটপাতের ওপর একটা ছাদ তৈরি করেছে। ফুটপাতটিকেও পতিত ফেলে রাখেনি সে। কিছু দূর পরপর হরেক রকম গাছ লাগিয়েছে। এর কোনোটা ফুটপাতে গর্ত করে লাগানো, আবার কোনোটা বড়ো টবে লাগানো।
আজগর আলী মাস্টার ভাবেন, তাইতো, শাহীনের চিন্তাই ঠিক। জায়গা ফেলে রেখে কী লাভ! বরং ফুটপাতের জায়গাটা কাজে লাগানোয় বাসার সৌন্দর্য বেড়েছে। আবার বাসার বারান্দাগুলোও বেশ প্রশস্ত হয়েছে। আজগর আলী মাস্টারের মনে হয়, তিনি এই মার্জিন ইস্যুতে তাঁর ছাত্রের কাছে এক পরাজিত শক্তি। তাঁর এই সেকেলে ধ্যানধারণা পরিবর্তনের সময় এসেছে। যত শীঘ্র সম্ভব এটাতে তাঁর পরিবর্তন আনতে হবে। মার্জিন ইস্যুতে আর বকাঝকা করা যাবে না। আজগর আলী মাস্টার একদম চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। আজই গ্রামে ফিরে যাবেন। আর তিনি ফিরবেন এক নতুন আজগর আলী মাস্টার হিসেবে যিনি কাউকে মার্জিন নিয়ে আর কোনোদিন কোনোকিছু বলবেন না।
আজগর আলী মাস্টার শাহীন চৌধুরীর বাসা সামনে থেকে মুখ ঘুরিয়ে ফিরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতেই বাসার বিশাল দরজা খুলে যায়। একটা গাড়ি বের হয়ে আসে। গাড়িটা রাস্তায় নামতেই থেমে যায়। আজগর আলী মাস্টারকে চিনতে মোটেও ভুল হয়নি শাহীন চৌধুরীর। তাড়াতাড়ি করে গাড়ি থেকে নেমে আসে সে। আজগর আলী মাস্টারের সামনে এসে বলে, “আসসালামু আলাইকুম, স্যার! আপনি এখানে? কখন এসেছেন স্যার?”
আজগর আলী মাস্টার কিছু বলতে গিয়েও থেমে যান। শাহীন চৌধুরী তার ড্রাইভারকে গাড়ি গ্যারাজে নিতে বলে আজগর আলী মাস্টারের হাত ধরে একরকম টেনে বাসার ভেতরে নিয়ে যায়। “আসেন স্যার! আমার কী সৌভাগ্য! আপনি আমার বাসায় এসেছেন।”
আজগর আলী মাস্টার তখনও স্বাভাবিক হতে পারেননি। তিনি ভাবছেন, তাঁর যেমন অতীতের সবকিছুই একদম স্পষ্ট মনে আছে, তেমনি শাহীনও নিশ্চয় কোনোকিছু ভুলে যায়নি। মার্জিন নিয়ে তাকে যত বকাঝকা করেছেন বা মারপিট করেছেন, তার সবকিছুর জন্য শাহীনের কাছে আজ তাঁর অনেক কথা শুনতে হতে পারে। এরকম একটা প্রস্তুতি আজগর আলী মাস্টার মনে মনে নিয়ে ফেলেছেন। কিন্তু শাহীন তাঁকে অবাক করে দিয়ে এ বিষয়ে কোনো শব্দও উচ্চারণ করল না ।
রাতের খাবার শেষে আজগর আলী মাস্টার তাঁর ছাত্র শাহীন চৌধুরীর সাথে বারান্দায় বসলেন। বিশাল বারান্দা। দুটো চেয়ার, ছোট্ট একটা টি-টেবিল ছাড়াও টবে হরেক রকমের গাছ লাগানো। তারপরও অনেক ফাঁকা জায়গা পড়ে আছে। আজগর আলী মাস্টার কথার এক ফাঁকে নিজে থেকেই বলতে চাইলেন, মার্জিন নিয়ে তাঁর চাপাচাপির কথা। শাহীন চৌধুরীর প্রতি তাঁর ক্ষোভের কথা। স্কুলে থাকার সময় তাঁর মারপিট আর বকাঝকার কথা। ভাবলেন, সবকিছু শাহীন চৌধুরীকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে তাঁর নিজের থেকেই ক্ষমা চাওয়া উচিত। সারা জীবনে তিনি কত যে কাগজের অপচয় করেছেন, তার হিসাব মেলানো মুশকিল। কিন্তু, এসব না বলে তিনি একটু অন্যভাবে এগোতে চাইলেন। বললেন, “তোমার বারান্দার প্ল্যানটা অনেক সুন্দর। আমি এত বড় বারান্দা কোথাও দেখিনি। অহেতুক জায়গা ফেলে রেখে কী লাভ! তোমার বুদ্ধিই ভালো।”
শাহীন চৌধুরী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে, “আমার বুদ্ধি ভালো না, স্যার!”
“কে বলেছে তোমাকে যে তোমার বুদ্ধি ভালো না? যে বলেছে, সে ভুল বলেছে।”
“না, স্যার! ভুল বলেনি সে। আর আপনি সবাইকে মার্জিনের ব্যাপারে যেভাবে বকা দিতেন বা মারপিট করতেন, সেটাই ঠিক ছিল।”
আজগর আলী মাস্টার তাঁর ছাত্রের মুখে এরকম কথা শুনে একটু অবাকই হলেন। ভাবলেন, শাহীন এসব কী বলছে! মাথা ঠিক আছে তো!
আজগর আলী মাস্টার বললেন, “কিন্তু আমি তো দেখছি তোমার মার্জিন না রাখার অভ্যাস বেশ কাজে দিয়েছে তোমার। বাসাটা আশপাশের বাসাগুলোর চেয়ে অনেক বড়ো হয়েছে। ফুটপাতের ওপর লাগানো গাছ বাসাটাকে আলাদা একটা সৌন্দর্য দিয়েছে। আর এই বারান্দাগুলোর তো কোনো কথায় নেই।”
“না, স্যার, আমি ভুল করেছি। একটা নোটিশ পেয়েছি। ওরা বারান্দাগুলো ভেঙে ফেলতে বলেছে।এ বাসায় কোনো বারান্দায় থাকবে না। কারণ বাসা করার সময় যে জায়গা ফাঁকা রাখার কথা ছিল, সেখানেই বারান্দাগুলো করেছি আমি।” কথাগুলো বলে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলল শাহীন চৌধুরী।
শাহীন চৌধুরীর বাসা থেকে যেদিন বিকেলে আজগর আলী মাস্টারের গ্রামে ফেরার কথা সেদিন দুপুরের আগেই তাঁকে বাসা থেকে বের হয়ে আসতে হলো। এগারোটার দিকে তিনি তাঁর ব্যাগ গুছিয়ে সবে গোসলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, এমন সময় বিকট একটা শব্দে পুরো বাসাটা কেঁপে উঠলো। কী হয়েছে তা দেখার জন্য তিনি বারান্দার দিকে দৌড় দিলেন। বারান্দায় পৌঁছার আগেই দেখলেন শাহীন চৌধুরীর ছোট মেয়েটা তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে, “বাবা, ওরা আমাদের বারান্দার সব গাছ ভেঙে ফেলেছে।” পাশে শাহীনের বৌ কাঁদছে। আবার একটা শব্দ হলো। তিনি বারান্দার দিকে এগোতেই শাহীন বলল, “বারান্দা আর নেই স্যার। ওরা ভেঙে ফেলেছে।” আজগর আলী মাস্টার ড্রয়িং রুমের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালেন। বিশাল আকারের দৈত্যের মতো একটা মেশিন তার দাঁত দিয়ে পাশের বারান্দার গ্রিলটাকে এক টানে নিচে নামিয়ে ফেলল। তিনি ভয় পেয়ে সেখান থেকে সরে আসলেন। শাহীনকে বললেন, “আমি গ্রামে ফিরে যাই। আমার জরুরি কাজ আছে।”
শাহীন ভাবলেশহীনভাবে বলল, “ঠিক আছে স্যার।”
আজগর আলী মাস্টার শাহীনের বাসার বাইরে দাঁড়িয়ে একবার ফিরে তাকালেন। দোতলা আর তিনতলার বারান্দার কিছুই অবশিষ্ট নেই। ফুটপাতের ওপর লাগানো গাছগুলোও নেই। বাসার সীমানা প্রাচীর ভেঙে ফেলা হয়েছে। পাশের বারান্দাগুলোও ভেঙে ফেলার জন্য সাত দিনের সময় দেওয়া হয়েছে। শাহীনের জন্য তাঁর খুব কষ্ট হচ্ছিল। ভাবলেন, এবার যদি তার মার্জিনের শিক্ষাটা হয়!
আজগর আলী মাস্টার বাড়ি ফিরে সোজা চলে গেলেন তাঁর স্কুলে। সবাইকে খুব দ্রুত হাজির হতে বললেন। সবাই আসার পর বেতটাকে বাতাসে ঘুরিয়ে বললেন, “মার্জিন ছাড়া আমার সামনে কোনো খাতা আসলে সেই খাতার মালিককে সাথে সাথে স্কুল থেকে বের করে দেবো। কোনো মাফ নেই। সে যত বড়ো বংশের হোক। মার্জিন টানতেই হবে। নাহলে আজগর আলী মাস্টারের স্কুলে তার জায়গা নাই।”
(প্রথম প্রকাশ- নতুন এক মাত্রা, মার্চ-এপ্রিল ২০২৩)