মাটির কলসে বন্দী পরান পাখি
১
কাজীপাড়া গ্রামের কাজীবাড়িতে কান্নার রোল ওঠে। বাড়ির মেয়েমানুষদের কান্না থামানো যাচ্ছে না। দুই দিন আগেও এ বাড়িতে শোকের মাতম উঠেছিল কাজী বাড়ির শেষ বংশধর মারা যাওয়ার পরে। সেই শোকের রেশ কাটিয়ে স্বাভাবিক হওয়ার পথেই ছিল পরিবারের লোকজন। কিন্তু এরই মাঝে সংবাদটা এল।
একটা মাটির কলস পাওয়া গেছে কাজীদের পুকুরে। পুকুরের পাশের উঠানে ক্রিকেট খেলছিল কয়েকজন ছেলে। বল পুকুরে পড়লে একজন পানিতে নেমে খুঁজতে গিয়ে পায়ে কলসের ছোঁয়া লাগে। পুকুরের এক কোণায় পানির নিচে পুঁতে রাখা একটা খুঁটির সাথে বাঁধা ছিল কলসটা। মাগুর মাছে ভর্তি হয়ে আছে মনে করে সে খুঁটিসহ তুলে আনে আস্ত কলস।
কলসটা এনে রাখা হয়েছে বাড়ির উঠানে। কলসের মুখ পলিথিনের ব্যাগ দিয়ে পেঁচিয়ে গলায় রশি দিয়ে বাঁধা। রশির আরেক প্রান্ত বাঁশের খুঁটির সাথে বাঁধা। নাইলনের রশি দিয়ে বাঁধা হয়েছে যাতে সহজে পঁচে না যায়। কলসের গায়ে আরবী হরফে খোদাই করে লেখা আছে রিশাত কাজীর নাম। নিচে তার পিতা রশিদ কাজীর নাম। তার নিচে লেখা, সাকিন – কাজীপাড়া। রশি দিয়ে বাঁধা কলসের মুখের পলিথিন খুলে ফেলতেই ভেতর থেকে দুর্গন্ধে ভরা পানি বের হয়ে আসে। সাথে আসে একটা মরা শিং মাছ। শিং মাছের মাথার কাছে কাঁটা বরাবর নাইলনের সুতা দিয়ে একটা তাবিজ বাঁধা।
কাজীবাড়ির উঠানে আরেকবার কান্নার রোল ওঠে। গ্রামের মেয়েমানুষরাও তাদের কান্নায় যোগ দেয়। রিশাত কাজীর মায়ের হাহাকারে ভারী হয়ে ওঠে পুরো এলাকা। ‘ওরে হামার মানিক রে! আর দুই দিন আগে যদি কলসি পাওয়া গ্যালো হিনি! হামার মানিক! আহারে! হামার মানিকের পরান কলসির ভিতর কত যে লাফালাফি করচে! তোরা কেউ আগে দেকিস নি ক্যা? হামার মানিকের জান কলসির ভিতর বান্দ্যা থুইয়া মারচে!’
এভাবে একটানা বিলাপ করে অজ্ঞান হয়ে যাচ্ছেন। জ্ঞান ফিরলে আবার শুরু। রিশাতের বউ কলসের এক পাশে নিস্তেজ হয়ে পড়ে আছে। মুখে কোনো শব্দ নাই। শুধু ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে মৃত শিং মাছের দিকে।
কাজীপাড়া গ্রামের মানুষের বোঝার কিছুই বাকি থাকেনা আর। রিশাত কাজীকে জাদুটোনা করে মারা হয়েছে। এই শিং মাছ যদি মারা যাওয়ার আগেই কলস থেকে বের হয়ে আসতে পারত, তাহলে বেঁচে যেত রিশাত কাজী। শিং মাছ যেহেতু কলসের ভেতরেই মারা গেছে, তাই রক্ত বমি হয়ে মারা গেছে রিশাত কাজী। অবশ্য যে এই জাদু করেছে সে কোনো ফাঁকফোঁকর রাখেনি তার কাজে। নাইলনের রশি ব্যবহার করেছে যাতে সহজে পঁচে না যায়। কলসটা খুঁটির সাথে বেঁধে রেখেছিল যাতে পানির ওপরে উঠে আসতে না পারে। আর সহজে কারও চোখে না পড়ে। আবার পুকুরের যে কোণায় রেখেছে, সেখানে কেউ ঘুণাক্ষরেও নামে না। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, খুব চালাক একজন মানুষের কাজ।
গ্রামের মানুষের মনে সন্দেহ দানা বাঁধে। তাহলে, দিন দশেক আগে মুখ দিয়ে রক্ত উঠে মারা যাওয়া রিফাত কাজীকেও জাদুটোনা করা হয়েছিল। কারও কিছু বলার আগেই গ্রামের লোকজন দল বেঁধে পুকুরে নামে। আধা ঘণ্টার মধ্যেই পাওয়া যায় আরেকটা কলস। একইভাবে বাঁশের খুঁটির সাথে বাঁধা ছিল। কলসের গায়ে আরবী হরফে খোদাই করে লেখা আছে রিফাত কাজীর নাম। নিচে তার পিতা রশিদ কাজীর নাম। তার নিচে লেখা, সাকিন – কাজীপাড়া। রশি আর পলিথিন দিয়ে বাঁধা কলসের মুখ খুলতেই ভেতর থেকে দুর্গন্ধে ভরা পানি বের হয়ে আসে। সাথে আসে শরীর পঁচে খুলে যাওয়া অর্ধেক একটা শিং মাছ। শিং মাছের মাথার কাছে কাঁটা বরাবর নাইলনের সুতা দিয়ে একটা তাবিজ বাঁধা।
কাজীবাড়ির উঠানে আরেকবার কান্নার রোল ওঠে। এবার আর কান্না থামার কোনো লক্ষণ নাই।
২
কাজীপাড়া গ্রামের কাজী বংশের লোকজনের সুনাম এ তল্লাটে সবার জানা। তাদের কোনো শত্রু থাকতে পারে, এটা কেউই বিশ্বাস করে না। যুদ্ধের পর থেকে আটানব্বই সালের বন্যা পর্যন্ত এই ইউনিয়নে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে, তার সবগুলোতেই কাজী পরিবার থেকে চেয়ারম্যান পদে জয়লাভ করেছে। কিন্তু তার পর থেকে পাল্টে গেছে ইলেকশনের হিসাব। ইলেকশনের বছর এলেই কাজী বংশ হতে যেই ভোটে দাঁড়ায়, সেই মারা যায়। সবগুলো মৃত্যুই অস্বাভাবিক ধরনের। এসব মৃত্যু নিয়ে নানা ধরনের মতামত প্রচলিত আছে।
এক দলের মত, অভিশাপ লেগেছে মানুষের। বানের রিলিফ মেরে খাওয়ার অভিশাপ।
আরেক দলের মত, কাজী বংশের লোকেরা নিজেরাই নিজেদের মারছে। তা নাহলে অন্য সময় না মরে শুধু ইলেকশনের সময়ই এরা মারা যায় কেন?
নজু পরামানিকের মত আবার একদমই ভিন্ন। কাজী পরিবারের সবাই খুব ভালো মানুষ। বানের রিলিফ মেরে খাওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না। কারণ আল্লাহ্ তাদের অনেক সম্পদ দিয়েছেন। আর নিজেরা নিজেদের মারবে, এ রকম কথাও তিনি বিশ্বাস করেন না। জন্মমৃত্যু আল্লাহ্র হাতে। অধম মানুষের কী সাধ্য আছে তার ভাগ্যে হেরফের করার।
হেরফের করা যায় না বলেই আটানব্বই সালের বন্যার পর থেকে নজু পরামানিকের বিরুদ্ধে কাজী বংশের যে-ই ইলেকশন করেছে সে-ই মারা গেছে। ফলে তার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়া কেউ ঠেকাতে পারেনি।
এখানে আবার মজার একটা খেলা আছে। কাজীপাড়া ইউনিয়নের কাজীপাড়া গ্রাম বিশাল বড়। এই গ্রামের ভোটার সংখ্যা ইউনিয়নের বাকি ছয়টা গ্রামের চেয়ে বেশি। যে কারণে কাজীপাড়া গ্রামের মানুষ যাকে ভোট দেবে তাকে ঠেকানোর ক্ষমতা বাকি ছয় গ্রামের ভোটারদের হাতে নেই। শুধু যে কাজটা করতে হয় তা হলো, কাজীপাড়া গ্রামের ভোট যাতে ভাগাভাগি না হয়, এখান থেকে যাতে একজন প্রার্থীই ভোটে দাঁড়ায়। নজু পরামানিকের ইলেকশন করার আগে পর্যন্ত কাজী পরিবার থেকেই চেয়ারম্যান হতো। কিন্তু তিনি আসার পর থেকেই মরণখেলা শুরু হয়ে যায়। মৃত্যুকে ঠেকানোর ওষুধ তো আর তার হাতে নাই। তবে রিশাত কাজী আর রিফাত কাজীর মৃত্যুর ধরন নজু পরামানিককে বেশ অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছে। মৃত্যুগুলো আসলেই বেশ ভীতিকর। তিনি কাজীবাড়ির আঙিনায় রিশাত কাজীর লাশ পড়ে থাকতে দেখেছেন। পুরো জামা রক্তের দলায় মাখামাখি। প্রথম দেখায় মনে হতে পারে কেউ একজন কুপিয়ে হত্যা করে রেখেছে। কী ভয়ংকর দৃশ্য! ভুলতে পারছেন না কিছুতেই। বারবার ভেসে উঠছে মনের চোখের পর্দায়।
৩
নজু পরামানিকের মনে হলো লাল রঙের গামছায় মুখ মোছার পর সেখানে কিছুটা রক্তের ছোপ লেগে গেল। তার মুখ থেকে কি রক্ত বের হচ্ছে? অসম্ভব! এবার সাদা লুঙ্গি দিয়ে মোছে। লুঙ্গিতে দলা দলা লাল রক্ত। আতঙ্কে তার দম বন্ধ হয়ে আসার মতো অবস্থা। বিছানা থেকে নামতে চায়। মুখ থেকে গল গল করে রক্ত বের হয়ে আসে বমির মতো। ঘরের মেঝে রক্তের কাদা দিয়ে একাকার। পা বাড়িয়ে সামনে যাবে তারও উপায় নেই। এমনিতেই শ্বাস নিতে পারছে না। এর মধ্যে যদি আবার পা পিছলে পড়ে যায়, তাহলে আর রক্ষা নাই। প্রাণপাখি উড়ে যাবে এক নিমিষেই। পা সামনে বাড়াবে কি বাড়াবে না, এমন দোটানার মধ্যেই বাইরে থেকে চিৎকার শুনতে পায়। ঘুম ভেঙে যায় নজু পরামানিকের।
বাইরের চিৎকার আরও বেড়েছে। ‘নজু ভাইয়ের মার্কা কী? কলসি ছাড়া আবার কী’। ‘নজু ভাইকে দিলে ভোট, শান্তি পাবে গাঁওয়ের লোক’। নজু পরামানিকের চোখ যায় ঘরের মেঝেতে। কোনো রক্ত নাই। লুঙ্গি নেড়েচেড়ে দেখেন। কোথাও রক্তের চিহ্ন নাই। বালিশের পাশে রাখা লাল গামছা উল্টে পাল্টে দেখেন। একদম পরিষ্কার। স্বপ্ন দেখেছেন। সবচেয়ে বড় কথা, বেঁচে আছেন নজু পরামানিক। কিন্তু যে স্বপ্ন তিনি দেখেছেন তা মোটেও ভালো লক্ষণ নয়। কাজীপাড়া গ্রামের কাজী বংশের শেষ দুই পুরুষ গত মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মারা গেছেন। মুখ দিয়ে রক্ত উঠেছিল মারা যাওয়ার আগে। ইলেকশনের আগে এরকম একটা স্বপ্ন একদম আশা করেননি তিনি । তাও আবার সকালবেলার স্বপ্ন। এ স্বপ্ন সত্য হবেই। ভাবতে ভাবতে বিছানা ছাড়েন নজু পরামানিক।
সবাই নজু পরামানিক নামে চিনলেও তার আসল নাম নজরুল প্রামানিক। কাজীপাড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। আগামী সপ্তাহে যে ইলেকশন হবে সেখানেও তিনি চেয়ারম্যান প্রার্থী। কলস মার্কা। তাকে ঠেকানোর মতো প্রার্থী এ তল্লাটে নাই। এই ইলেকশনের আগে তিনি পরপর চারবার চেয়ারম্যান হয়েছিলেন। কাজী পরিবার থেকে কোনো প্রার্থী না থাকায় গ্রামের ইজ্জত রক্ষার দায়িত্ব আবারও পড়েছে নজু পরামানিকের ওপর। কারণ কাজীপাড়া গ্রামের নামে ইউনিয়নের নাম। এই গ্রাম থেকে চেয়ারম্যান হতেই হবে।
কাজীপাড়া গ্রামে এককালে কাজী বংশের লোকজন দিয়েই ভরা ছিল। প্রামানিক ছিল মাত্র এক ঘর। বছির উদ্দিন প্রামানিক। সবাই জানে বছু পরামানিক। সে চার পুরুষ আগের কাহিনি। সেখান থেকে পরামানিকদের প্রভাবপ্রতিপত্তি বাড়তে বাড়তে কাজীদের নামনিশানা একদম ধুয়ে মুছে দেয়। পুরুষহীন একটা পরিবার, গ্রামের নাম, আর ইউনিয়নের নাম আর পোস্ট অফিসের নাম – এছাড়া কাজীদের এখন কিছুই নাই। সব প্রামানিকদের দখলে। গ্রাম, ইউনিয়ন আর পোস্ট অফিসের নাম তো আর পরিবর্তন করা সম্ভব নয়। তবে বরাবরের মতো চেয়ারম্যানের পদটা নেওয়া খুবই সম্ভব যদি তার স্বপ্নটা বাধা হয়ে না দাঁড়ায়।
৪
গ্রামে মিটিং ডাকলেন নজু পরামানিক। ‘হামি আজ অ্যাকটা খারাপ স্বপন দেকচি। গাঁয়ের সব মরদ মানষের অক্ত বমি হচ্চে। অ্যাকসাতে সব মর্যা যাচ্চে। অ্যাকন তোমরাই কও কী করবা?’
লোকজন সব এর ওর দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করে।
একজন বলে, ‘আপনিই কন কী করা লাগবে । হামরা সব করবার রাজি আচি।’
নজু পরামানিক বলে, ‘কাজীরা কীভাবে মরচে মনে নাই? মাটির কলসিত কর্যা ওরকে জান বান্দ্যা থুচলো পানির মদ্যে। হামরা জুদি সব পকুরের পানি শুকা ফাল্যা দিয়া পারি, তালে মনে করো কলসি লুক্যা থোয়ার আর কুনু জায়গা থাকলো না।’
একজন বলে ওঠে, ‘হামাকরক কী করা লাগবে খালি তাই কন।’
‘কিচ্চু করা লাগবে না, খালি সব পকুর শুকায়া খটখটা কর্যা ফাল্যা দ্যাও।’
উপস্থিত সবার মধ্যে গুঞ্জন ওঠে। নজু পরামানিক দ্রুত বিষয়টা আঁচ করতে পেরে বলে ওঠেন, ‘ ঠিক আচে। তোমরা তালে সব পকুর সেঁচা শুরু করো। আর কলসি খুঁজা বার করো। হামি গরু জবো করার ব্যবস্থা করিচ্চি। গাঁওয়ালি মজলিস। গাঁওয়ের সব মানষের দাওয়াত। হামরা আজ সগলি মিল্যা অ্যাকসাতে খামো। আর হামার পকুরের সব মাচ তোমরা সগলি ভাগ কর্যা ল্যাও।’
এবার সবাই নজু পরামানিকের কথায় হাততালি দেয়। সবাই খুশি। কী বুদ্ধি এই মানুষের! এমনি কী আর তিনবারের চেয়ারম্যান! পুকুর আর ডোবাগুলো যদি শুকিয়ে ফেলা যায়, তাহলে তো আর কলস লুকিয়ে রাখার কোনো জায়গাই থাকলো না। আর কলসে যদি তাদের জান বন্দী করে না রাখতে পারে, তাহলে রক্তবমি হয়ে মারা যাবে না কেউ।
কাউকে আর কিছু বলতে হলো না। সবাই যে যার মতো করে কাজে লেগে গেল। যাদের বাড়িতে সেচের পাম্প ছিল, তারা পুকুরের পাশে বসানোর কাজ শুরু করে দিল। কেউ মোটর সাইকেল নিয়ে ডিজেল আনতে গেল থানা শহরে। ছোট পুকুর আর ডোবাগুলোতে কেউ কেউ জাঁত বসালো। কোথাও আবার দুজন মিলে সিয়ানি দিয়ে পানি সেচতে লাগল। সারা গ্রাম জুড়ে সে এক এলাহি কাণ্ড। একেকটা পুকুর শুকিয়ে ফেলার পর কলস না পেয়ে আনন্দে সবাই হৈ হুল্লোড় করছিল। সাথে যোগ হচ্ছিল মাছ ধরার আনন্দ।
বিকাল না গড়াতেই একরকম নিশ্চিত হওয়া গেল কোথাও কোনো কলসের চিহ্ন পর্যন্ত নাই। বাড়ি বাড়ি মাছ কাটার ধুম। অনেকেই জিয়ল মাছ মাটির কলসে ভরে রাখতে চাইল। কিন্তু চেয়ারম্যান সাহেবের কড়া নির্দেশ ‘গ্রামে কোনো কলস থাকবে না’। অগত্যা সবাই মাছ রান্না করেই রাখল। কেউ কেউ আবার বুদ্ধি করে শুঁটকি করার জন্য সুতায় গেঁথে টিনের চালায় ফেলে রাখল। যে যাই করুক সব জায়গায় একটা খুশির হাওয়া বয়ে যাচ্ছিল। রিশাত কাজী মারা যাওয়ার পর ইলেকশন পিছিয়ে যাওয়ায় গ্রামের মানুষের মধ্যে একটু মনখারাপের ভাব চলে এসেছিল। কিন্তু আজকের এই মাছ ধরার উৎসব, গাঁওয়ালি মজলিস, পুকুরে মাটির কলস না থাকা, সবার হাতে হাতে নজু পরামানিকের দেওয়া পাঁচশ টাকার কড়কড়ে নোট, এসবের আনন্দ মিলে সারা গ্রামে ইলেকশন জিতে যাওয়ার অনুভূতি। নজু পরামানিকের খুশি আরও এক ডিগ্রি বেশি। খরচ কিছু হয়েছে, তাতে কি! জানে বেঁচে গেছেন, এটাই বড় পাওনা।
সবার অগোচরে আরও একটা কাজ করেছেন নজু পরামানিক। মনা ফকিরের ছেলের হাতে টাকার কয়েকটা বাণ্ডিল দিয়ে তাকে দেশান্তরী হতে বলেছেন। কালসাপকে বিশ্বাস করা যায় না। কখন যে ছোবল মেরে বসবে তার ঠিকঠিকানা নাই।
৫
মনা ফকিরকে গ্রামের মানুষ ভয় পায়। তার আশেপাশে ভিড়তে চায় না কখনও। তাকে নিয়ে অনেক গল্প প্রচলিত আছে কাজীপাড়া গ্রামে। জিনপরী তাড়াতে পারতেন চোখের নিমিষে। বড় ছেলেকে হারানোর পর থেকে তিনি আর কোথাও জিনপরী ছাড়াতে যান না। কোমরের কাছে ধনুকের মতো বেঁকে যাওয়া লিকলিকে গড়নের শরীরটা দেখে মানুষ যতটা না ভয় পায়, তার চেয়ে বেশি ভয় পায় তার সাথে থাকা জিনের কথা ভেবে। সবাই বিশ্বাস করে, মনা ফকির এখনও চার-পাঁচটা পোষা জিন সাথে নিয়ে ঘোরেন সব সময়। তাই তার সাথে কথা বলতে গেলেও ভেবে চিন্তে বলে।
মনা ফকির তার বড় ছেলে সানা ফকিরকে হারিয়েছেন প্রায় ত্রিশ বছর আগে। জিন ছাড়াতে যাওয়ার সময় সবাইকে বাড়ির বাইরে যেতে নিষেধ করেছিলেন। তিনি চলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই কালো মেঘে অন্ধকার হয়ে যায় চারদিক। মুষলধারে বৃষ্টি শুরু হয়। বৃষ্টিতে বাড়ির উঠানে পানি জমে যায়। সেই পানিতে অসংখ্য কই মাছ লাফালাফি করতে থাকে। এত মাছ দেখে সানা ফকির নিজেকে আর সামলাতে পারেনা। মা বারবার নিষেধ করলেও কই মাছ ধরতে চলে যায় বাড়ির বাইরে। উঠানে পা দিতেই পিছলে পড়ে যায়। তার আর ওঠা হয়নি। দুষ্টু জিনেরা ঐখানেই তাকে মেরে ফেলে রাখে।
ছেলেকে হারানোর ঘটনা মনা ফকিরের জন্য একটা বিরাট শিক্ষা। ছোট ছেলে রানা ফকিরকে আগলে রেখে বড় করেছেন। ছেলেটা যাতে এগুলো না শিখতে পারে সেজন্য জাদুটোনার সব বই ট্রাংকে তালা দিয়ে বন্ধ করে রেখেছেন। কিন্তু কাজী বংশের দুই ভাইয়ের মৃত্যুর ঘটনা আর নজু পরামানিকের সাথে রানার সন্দেহজনক চলাফেরা মনা ফকিরকে ভাবিয়ে তুলেছিল। রানার হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়ার পর গ্রামের লোক না বুঝলেও তিনি সব বুঝে ফেলেন। আরও নিশ্চিত হন যখন চৌকির নিচ থেকে ট্রাংক বের করে দেখেন ওটাতে কোনো তালা নেই।
ট্রাংক খুলে একটা বই হাতে নিয়ে কী যেন খুঁজতে থাকেন। অনেক কিছুই ভুলে গেছেন। আবার দেখেন। এক পৃষ্ঠায় এসে তার চোখজোড়া থমকে যায়। তার পর ইচ্ছা করেই সেখানে থেমে থাকেন কিছুক্ষণ। বিড়বিড় করে পড়তে শুরু করেন। পড়া শেষ করে বইটা ট্রাংকে রেখে তাকে টেনে উঠানে নিয়ে যান। একটা কাঁচের বোতল থেকে বইগুলোতে কেরোসিন ঢেলে দেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সেগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়। মনা ফকির বিড়বিড় করে কী যেন পড়েন আবার। ততক্ষণে তার চোখজোড়া চলে গেছে ছোট এক খেজুর গাছে লটকে থাকা মাটির কলসের দিকে। মনে মনে ভাবেন, আরেকটু রস পড়ুক। দুই গ্লাস খেয়েই কাজে লেগে যাবেন। সারা শরীরে একটা রোমাঞ্চকর অনুভূতি। অনেকদিন পর আবার তার শরীরে পরিচিত একটা শিহরণ খেলে যায়।
৬
নজু পরামানিকের লাশ পড়ে আছে তার উঠানে। মুখের চারপাশে রক্ত দিয়ে মাখামাখি। গ্রামের লোকজনের চোখেমুখে অবিশ্বাসের ছাপ। সবার সন্দেহ, কাজি বংশের সব পুরুষ নিশ্চিহ্ন হওয়াতে ঐ বংশের অভিশাপ চলে এসেছে পরামানিক বংশে। এই বংশের যে পুরুষ ইলেকশনে দাঁড়াবে তারই অপঘাতে মৃত্যু হবে। কিন্তু নজু পরামানিকের জান কলসে বন্দী করে কোথায় রাখা হয়েছিল সেটা নিয়ে জল্পনা-কল্পনা চলে কয়েকদিন। সব পুকুর, ডোবা শুকনো খটখটা। কলস ডুবিয়ে রাখার মতো পানি কোথাও নাই।
নজু পরামানিকের কবর দেওয়ার এক সপ্তাহ পরে বাড়ির কামলাদের জন্য তৈরি করা পায়খানা ভরে গিয়ে উপচে ওঠে। পরিষ্কার করার জন্য মেথর ডাকা হয়। সেফটি ট্যাংকের ওপর থেকে সিমেন্টের স্লাব সরাতেই একটা মাটির কলস পাওয়া যায়। কলসের গায়ে আরবী হরফে খোদাই করে লেখা আছে নজু পরামানিকের নাম। নিচে তার পিতা বজু পরামানিকের নাম। তার নিচে লেখা, সাকিন – কাজীপাড়া। রশি দিয়ে বাঁধা পলিথিন দিয়ে পেঁচানো কলসের মুখ খুলতেই ভেতর থেকে বের হয়ে আসে মরা শিং মাছ। শিং মাছের মাথার কাছে কাঁটা বরাবর সুতা দিয়ে একটা তাবিজ বাঁধা।
গ্রামজুড়ে হাহাকার ছড়িয়ে পড়ে। আহারে! আর কয়েকদিন আগে কলসটাকে খুঁজে পেলেই বাঁচানো যেত নজু পরামানিককে। মাটির কলসে বন্দী হয়ে চেয়ারম্যান সাহেবের প্রাণপাখি শিং মাছটা কতই না ছটফট করেছে। কাজী বংশের শেষ দুই পুরুষের মতো।
মনা ফকিরের প্রাণপাখির ছটফটানি এখনও থামেনি। তাইতো মাঝেমধ্যেই তাকে দেখা যায় কাজীদের পারিবারিক গোরস্থানের পাশে। ভাঁজ হয়ে যাওয়া শরীরটাকে আরও ভাঁজ করে চোখের জল ফেলেন। ছেলে হারানোর ব্যথা তিনি ছাড়া আর কে ভালো জানেন!
(প্রথম প্রকাশ- দৈনিক যুগান্তর, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২২)