বৃষ্টি অথবা ঘ্রাণের গল্প
আমি আমার পরিচিত যে-কোনো একটা দিনের মতো হাঁটু ভাঁজ করে আজ, এখন, এখানে এই পাবলিক বাসের ভেতরে বেশ কায়দা করে বসে আছি। বলা যায়, বেঁচে আছি। বেঁচে থাকার নেশায়, অথবা অফিস যাওয়ার আশায়। অতীতের যে-কোনো একটা দিনের মতো। হয়তো ভবিষ্যতেরও।
আজ বৃষ্টির একটু বাড়াবাড়ি আছে। জানালার কাচগুলো ঝুরি ঝুরি করে ভেঙে ফেলার মতো ভারী আওয়াজ তোলা, বেয়াড়া, রাগী বৃষ্টি। তার রাগ এমন চড়েছে যে থামার কোনো লক্ষণ নেই। আমার ভাবনাগুলো জমে যায়, “বৃষ্টির পানিতে রাস্তা তলিয়ে যাবে নাকি? তাহলে অফিসে যাব কীভাবে? বাঁচব কীভাবে? জরুরি একটা মিটিং আছে। কোনোভাবেই মিস করা যাবে না। মিস করলে চাকুরি থাকবে না। শেষে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে যাবে।”
গাড়িটা থেমে আছে। বৃষ্টি চলছে। মিছিলের শব্দ কানে আসে। মিছিলগুলো মনে হয় আমার মাথার মধ্যে বসে আছে। রাস্তায় গাড়ি থামলেই তারা হুড়মুড় করে নেমে পড়ে আমার চিন্তায়। আমিও সেখানে প্যাঁচ খেতে খেতে একসময় ঠিকই জট খুলে ফেলি, আরে না! এটা কোনো মিছিল নয়। বৃষ্টির শব্দ। বৃষ্টির মধ্যে মিছিল করার মতো দরদী কেউ নেই। মিছিল চলছে না। বরং বৃষ্টি চলছে। অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টিকে চলতে দেখে বাসটাও ঝিমুনি ছেড়ে চলতে এক-পা, দুই-পা করে চলতে শুরু করেছে। শুধু আমিই, আজ, এখন, এখানে হাঁটু ভাঁজ করে থেমে আছি পাবলিক বাসের মধ্যে।
ফেটে যাওয়া কাচের সরু গলিপথে ক্যাঁচ ক্যাঁচ শব্দ করে চিতসাঁতার দিয়ে আসা বৃষ্টির শীতল ঢেউ জানালার সাথে লেগে থাকা আমার হাতের উষ্ণতায় আছড়ে পড়ছে যখন তখন। আজ, এখানে, এখন এই ঢেউগুলো আমাকে শিরশির অনুভূতি দিয়ে যেখানে নিয়ে যাচ্ছে, সেখানে যাওয়ার সুযোগের অপেক্ষায় আমি প্রায়শই দম বন্ধ করে অন্ধকারে বসে থাকি। ঠিক একইভাবে, আজ, এখন, এখানে বাসের সিটকভারে আটকে পড়া গন্ধগুলো দম বন্ধ করে চোখ বুজে বসে আছে বৃষ্টি থেমে যাওয়ার প্রতীক্ষায়, যেন বৃষ্টির ঘামে ভেজা ঝাপসা জানালাগুলো খুলে যাওয়ার সাথে সাথে তারা চোখ খুলে সতেজ, শীতল বাতাসে বুক ভরে শ্বাস নেবে।
আজ, এখানে, এখন হঠাৎ করেই একটা পরিচিত গন্ধ আমার সায় পেয়ে নাকের ভেতর তাঁবু গেঁড়ে বসে পড়েছে। থাক। বসে থাক। ভালো লাগলে, ভালো রাখতে কোনো দ্বিধা ছাড়াই বরং একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। আমিও তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি, গন্ধটা তাহলে থাক। নাকের ভেতর বসে থাক। আমার কেন জানি মনে হচ্ছে, এই পরিচিত গন্ধের অপরিচিত একটা নেশা আছে, যে নেশার আবহে বুনো ফুলের প্রতিবেশি মৌমাছিরা ফুলের অন্তপুরে চুষনি লাগিয়ে হাঁটু গেঁড়ে বসে থাকে। গন্ধটা হাঁটু গেঁড়ে বসে থাক। আমিও তো হাঁটু ভাঁজ করে বসে আছি এই পাবলিক বাসের ভেতর।
জানালাটা কি খোলা যায়? বৃষ্টিকে আগের মতো রাগী আর বেয়াড়া মনে হচ্ছে না এখন। ভারী আওয়াজও নেই এখানে। কিন্তু গন্ধটা যে নাকের ভেতর তাঁবু গেঁড়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। বেচারা! বাতাসের দাবড়ানি খেয়ে খেয়ে ক্লান্ত হয়ে আজ, এখন, এখানে জানালাটা একটু বন্ধ পেয়ে আমার নাকের ভেতর নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। ঘুমাক। তার নাক ডাকার শব্দ আমার নাকের ভেতর অনবরত হাল্কা একটু সুড়সুড়ি দিলেও হাঁচিটাকে আটকে রেখেছি প্রাণপণ চেষ্টায়। গন্ধটাকে হাঁচির সাথে ছুঁড়ে ফেলতে মন চাইছে না কিছুতেই। বরং ভাবছি চোখদুটোকে কাজে লাগিয়ে গন্ধটা কোন পথে, কোথা থেকে আজ, এখন, এখানে এসেছে তার ব্যাপারে একটা অনুসন্ধান চালানো যায়।
তেল চিটচিটে, কালচে সিটকভারকে পাশ কাটিয়ে দুই ধাপ সামনে এগিয়ে গিয়েই সন্ধান মেলে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকা অগণিত কালো চুলের ঢেউ। এখানে, আমার চোখের কালো সাগরে এসেই তারা প্রাণ ফিরে পায়। আমিও তার সাথে প্রাণ মিলিয়ে চোখ বুজে আমার বাইরের সমস্ত পৃথিবীতে লোডশেডিং করে, একদম কালো অন্ধকার করে রেখে, সব আলো দিয়ে এক নিমিষেই আমার ভেতরটাকে সাজিয়ে ফেলি। হঠাৎ মনে হয়, এই আমি এখন যে আলোয় আটকা পড়েছি, আমার নাকের ভেতর এসে ঘুমিয়ে পড়া গন্ধটা ঐ ওখান থেকেই আসেনি তো? তার পাশের মানুষটি নড়াচড়া করছে। হয়তো নেমে যাবে। যাক! তার সাথে কি পাশের কালো চুলের মেয়েটাও নামতে পারে? না, কোনোভাবেই না। সে তো একদম স্থির হয়ে বসে আছে। তার অগণিত কালো চুলের ঢেউ ঠায় দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দাঁড়িয়ে রেখেই পরের স্টপেজে পাশের মানুষটা নেমে যায়।
কেউ কি এই স্টপেজে উঠতে পারে? উঠেই কোনো অনুমতির অপেক্ষা না করেই মেয়েটার অনিচ্ছাসত্ত্বেও কি তার শরীর ঘেঁষে বসে পড়তে পারে? আরে না! এত সহজ নয়! জরুরি কাজ না থাকলে একজনের কী দরকার আছে এই বৃষ্টিতে বাইরে বেরোনোর! নামেই তো স্টপেজ! কোনো যাত্রী-ছাউনিই তো এখানে নেই যে, একজন এসে বাসের অপেক্ষায় বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকবে! কেউ নেই! আশপাশে আর কারো আসার লক্ষণও দেখা যাচ্ছে না। আমার মনে হয়, আমি চিৎকার করে বলে উঠি, “এই স্টপেজে বাসে ওঠার কেউ নেই! ড্রাইভার সাহেব, কেন অযথা আমাদের সময় নষ্ট করছেন এখানে দাঁড়িয়ে থেকে? জ্বালানি তেলের অপচয় করছেন! আর এক মুহূর্তও দেরি নয়! বাসটা ছেড়ে দিন! প্লিজ ভাই! বাসটা ছেড়ে দিন! ড্রাইভিং সিটে বসেছেন তো কী হয়েছে? সবকিছুই কি আপনার ইচ্ছায় চলবে?” পেছন থেকে কয়েকজনের গলা শোনা যায়। ‘বাসটা ছাড়েন না ভাই!’ ‘অহেতুক কেন দাঁড়িয়ে আছেন?’ ‘পাবলিকের সময়ের কি কোনই দাম নেই?’ এই শব্দগুচ্ছগুলো ড্রাইভারের কানে গিয়ে ধাক্কা দেয় এবং সেই ধাক্কা সহ্য করতে না পেরে ড্রাইভার সাহেবও ধাক্কা দেন তার পায়ে। পা চাপ বাড়ায় এক্সিলারেটরে।
আমার মনেও একটা ধাক্কা লাগে। আমি কি তার পাশে গিয়ে বসব? বসতেই পারি। কিন্তু এখনই বসব? নাকি একটু পরে? আমি কালো চুলের মেয়েটার পাশে বসলে কেউ কি আপত্তি জানাবে? আপত্তি কীসের! যেহেতু ঐ ফাঁকা আসন বাসের দরজা থেকে আমার এই আসনের চেয়ে অধিকতর নিকটে, অথবা, যেহেতু আমি হয়তো কিছুক্ষণ পর বাস থেকে নেমে যেতে পারি, অথবা, যেহেতু এখানে, বাসের পেছনের দিকে ঝাঁকুনি একটু বেশি, অথবা, যেহেতু হয়তো শিলাবৃষ্টি এসে ফেটে যাওয়া জানালার কাচ পুরোপুরি ভেঙে আমি আঘাত পেতে পারি, অথবা, যেহেতু আমি যে আসনে বসে আছি, তার নিচে বাসের চাকা থাকায় এখানে পা রাখার জায়গাটা একটু বেশি উঁচু এবং যেহেতু এখানে বসতে আমার সমস্যা হচ্ছে, তাই আমি এখন আমার হাঁটুগুলোকে একটু আরাম দিতে সামনের ফাঁকা আসনে মেয়েটার পাশে গিয়ে বসতেই পারি। এতে পাবলিকের আপত্তি করার কী আছে?
আমি সেখানে বসলে মেয়েটা কি আপত্তি করতে পারে? আরে না! এটা পাবলিক বাস। সবার সমান অধিকার। মহিলা সিট হলে না হয় একটা কথা ছিল! আর ঐ সিটে যে আগে বসেছিল, তাকে ভালোভাবে দেখতে না পারলেও আমি নিশ্চিত যে আমি তার চেয়ে ভালো একজন সহযাত্রী। আর আমি তো সেখানে আমার কোনো বাসনা পূরণের জন্য যাচ্ছি না! যাচ্ছি নিতান্তই বেকায়দায় পড়ে যাওয়ার কারণে। আমার হাঁটুগুলোকে একটু দিতে। আমি তাহলে সেখানে কিছুক্ষণের মধ্যেই বসছি। সেই কালো চুলের মেয়েটার পাশে।
আমি একটু নড়েচড়ে উঠতেই আমার পাশের মানুষটি হাঁটুগুলোকে একটু সরে নিয়ে আমাকে পথ করে দেওয়ার চেষ্টা করেন। আমি তার দেখানো পথে বের হয়ে আমার দেখা পথ অনুসরণ করে দুই ধাপ সামনের আসনে বড় একটা বৃষ্টির ফোঁটার মতো টুপ করে বসে পড়ি। আমি আমার পাশের মানুষটাকে দেখতে না পেলেও চোখ বন্ধ করেই টের পাই, আমার নাকের ভেতর তাঁবু গেঁড়ে বসে পড়া আগের গন্ধটার জ্ঞাতিগোষ্ঠী সব এসে তাঁবু টাঙাতে টাঙাতে আমার নাকের ভেতর সমস্ত জায়গা দখল করে নিয়েছে। আমার শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে। হোক। তবুও গন্ধগুলোকে বাধা দিতে মন চাইছে না। ভালো লাগলে, ভালো রাখতে কোনো দ্বিধা ছাড়াই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। থাক। ওরা আরামে বসে থাক।
আমি আজ, এখানে, এখন এই পাবলিক বাসে বসে ভাবছি, বৃষ্টি আরও জোরে হওয়া উচিত। এবারের বর্ষা তো প্রায় শেষই হয়ে গেল। সারাদিন একটানা বৃষ্টির দেখা মিলল না তো এবার। আজ সেই বৃষ্টি হোক। রাত অবধি। রাস্তাগুলোও একদম ডুবে যাওয়া উচিত। এমনকি ফুটপাতও। আমাদের বাসটা পানিতে ঢেউ তুলে এগিয়ে যাবে, এ এক অভাবনীয় দৃশ্য! আমি ভাবি, অনেকদিন এ রকম দৃশ্য দেখা হয়নি। আজই দেখার সুযোগ মিললে ক্ষতি কী! অথবা রাস্তার পানি গাড়ির ইঞ্জিনে ঢুকে রাস্তার মাঝে কোমরসমান পানিতে যদি গাড়িটাই বিকল হয়ে যায়! এই বৃষ্টির মধ্যে অফিসে না গেলেই বা কী! কে ধরতে আসছে তাকে? পুরো শহরটাই তো আটকে আছে বৃষ্টিতে। আমি যদি আজ, এখন, এখানে এই সিটে নিশ্চল হয়ে আটকে থাকি কোনোরকমে, আমার পাশে বসা মেয়েটি কি বের হতে পারবে? কোনোভাবেই পারবে না!
আমার সিদ্ধান্ত মোটামুটি চূড়ান্ত। গন্ধটাকে যেভাবে নাকের ভেতর ঘুমানোর জায়গা করে দিয়ে আটকে রেখেছি, সেভাবে মেয়েটাকেও আটকে রাখব। প্রয়োজন হলে সে আমার ঘাড়ে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ুক। আমি তাকে একটুও বাধা দেবো না। সে তো আর ইচ্ছে করে হেলান দিচ্ছে না। হয়তো একটানা বসে থাকতে থাকতে ক্লান্তি পেয়ে বসায় কিছুক্ষণের জন্য তার কালো চুলে ঢাকা মাথাটাকে এলিয়ে দিয়েছে আমার ঘাড়ে। অথবা, তেল চিটচিটে সিটকভারের যন্ত্রণা সইতে না পারে তার চুলগুলোই মাথাটাকে টেনে এনেছে আমার ঘাড়ে, আমার পরিষ্কার শার্টের ওপরে। কারণ যাই হোক না কেন গন্ধটাকে যেভাবে আটকে রেখেছি, মেয়েটাকেও ঠিক একইভাবে আটকে রাখব।
আড়চোখে মেয়েটাকে একটু দেখি। তার সাথে আরেকটু দেখি বৃষ্টিতে ঘেমে যাওয়া জানালার কাচ। সাথে বাইরের বৃষ্টি। বাইরে চোখ পড়তেই হৃদপিণ্ডটা একটু থেমে যায়, বাইরের থেমে যাওয়া বৃষ্টির মতো। তবে কি বৃষ্টি থেমেই গেল এখন। আজ, এখানে, এখন বৃষ্টির এই আকস্মিক বিদায় নিশ্চয় বাসের জানালাগুলো এক ঝটকায় খুলে দেবে। বাসের সিটকভারে আটকে পড়া গন্ধগুলো তখন চোখ খুলে যেদিক পথ খুঁজে পাবে সেদিক দিয়েই দৌড়ে পালাবে। নাকের ভেতর ঘুমিয়ে পড়া গন্ধগুলোও হুড়মুড় করে বেরিয়ে পড়বে। মেয়েটা নিশ্চয় পরের স্টপেজেই নেমে যাবে।
আমার ধারণা সত্য প্রমাণ করে বাসের জানালাগুলো খুলে গেল। দম বন্ধ হয়ে থাকা গন্ধগুলো দৌড়ে পালাল। নাকের ভেতর ঘুমিয়ে পড়া গন্ধগুলোকে দ্রুত বের করে দিতে জোরে হাঁচি দিলাম – একবার, দুইবার, তিনবার। আমার ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে মেয়েটা আরও পাঁচটা স্টপেজ পরে বাস থেকে নেমে যাওয়ার জন্য নড়েচড়ে বসল। আমি তাকে অবলীলায় জায়গা করে দিলাম। ভালো লাগলে, ভালো রাখতে কোনো দ্বিধা ছাড়াই একটা সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যায়। যাক। নেমে যাক।
বাসের কন্ডাকটর যখন ‘লাস্ট স্টপেজ! লাস্ট স্টপেজ!! লাস্ট স্টপেজ!!!’ বলে চিৎকার করছিল, তখন আমি আমার অফিস, আমার বেঁচে থাকার অবলম্বনকে অনেক পেছনে ফেলে এসেছি। বাস থেকে যখন নামতে যাব, তখনই অপরিচিত বাতাসের এক শীতল ঝাপটা এসে মুখে লাগে। সে আমার পরিচিত একটা গন্ধ কাছে টেনে এনে আমাকে বলে দেয়, মেয়েটা আমার ঘাড়ে যেখানে মাথা রেখেছিল, সেখানেই সে আটকে আছে।
(প্রথম প্রকাশ- কালি ও কলম, এপ্রিল ২০২৩)