বাড়ি ভাড়া
এক
বিজ্ঞাপনটা ভালো করে আরো একবার দেখে সজল। একেবারেই অবিশ্বাস্য। দুই বেডের একটা বাসা। ড্রয়িং, ডাইনিং আলাদা। ১২৫০ স্কয়ার ফিট। ভাড়া মাসে আট হাজার টাকা। ঢাকার মিরপুর সি ব্লকে বাসার অবস্থান। ছয় তলায় পূর্ব পাশের ফ্ল্যাট। দক্ষিণমুখী। অনেক আগ্রহ নিয়ে সজল একই এলাকায় আরও কিছু বাসার ভাড়া দেখল। এই আকারের দুই বেডরুমের বাসা ভাড়া প্রায় ক্ষেত্রেই পনের হাজার টাকা। সাথে আবার সার্ভিস চার্জ, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল। বাসার পাশে কয়েকটা স্কুল আছে। ফলে এখানে আট হাজার টাকায় ৬৫০ স্কয়ার ফিটের বাসা পাওয়াই অসম্ভব।
সজল তার স্ত্রী রীনাকে বিজ্ঞাপনটা দেখাল। মীনা তো হেসেই অস্থির। “শোনো, আমি নিশ্চিত কোথাও একটা ভুল হয়েছে। প্রিন্টিং এ ভুল হতে পারে। আঠারো হাজার টাকার জায়গায় ভুলে আট হাজার লেখা হয়েছে। অথবা কোনো পাগলের কাজ হতে পারে।”
সজল বলে, “আরে বাবা, বিজ্ঞাপনে মোবাইল নম্বর তো দেওয়াই আছে। এত গবেষণার কী আছে! কথা বললেই সব খোলাসা হয়ে যায়। বিজ্ঞাপনে ভুল হয়ে থাকলে তাও জানা যাবে।”
রীনার হাসি থামছেই না। “তোমার অঢেল সময় আছে হাতে। লেগে থাকো এসবের পেছনে। আমি এসব পাগলামির মধ্যে নেই।”
সজল দেরি না করে সাথে সাথে বিজ্ঞাপনে দেওয়া নম্বরে কল করল। কয়েকবার রিংটোন বাজার পরও কেউ রিসিভ না করায় একটু বিরক্তই হলো সজল। এত বড় একটা সুযোগ। এত কম টাকায় এত বড় একটা বাসা। মিনিট দশেক পরে সজল আবার ঐ নম্বরে কল করল। এক বার। দুই বার। তিন বার। এইবার সজলের বিরক্তি রাগের পর্যায়ে চলে গেল। মোবাইল ফোনটা সোফার উপর ফেলে দিয়ে খবরের শিরোনামগুলো পড়তে লাগল।
রীনা চা নিয়ে এসেছে। পাশে বসেই হাসতে হাসতে বলল, “তোমার আট হাজার টাকার বাসা ভাড়া কনফার্ম হয়েছে?”
সজল কিছুটা রাগের সুরেই বলে, “সে কথা আর জিজ্ঞেস করো না। কল দিতে দিতে বিরক্ত হয়ে গেছি। কলই রিসিভ করে না।”
ঠিক তখনই সজলের মোবাইল ফোনে রিং টোন বেজে ওঠে। রীনাকে বলে, “এই চুপ, চুপ। হেসো না যেন। ঐ নম্বর থেকে কল ব্যাক করেছে।”
বাড়িওয়ালা ভদ্রলোকের সাথে কথা হলো সজলের। ভাড়া ঠিকই আছে। মাসে আট হাজার টাকা। সাথে সার্ভিস চার্জ, বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল। তবে কিছু শর্ত আছে।
শর্ত ১ – যারা ভাড়া নেবেন, তাদের এক বা একাধিক সন্তান থাকতে হবে। সন্তানের বয়স দশ বছরের নিচে হতে হবে।
শর্ত ২ – বাসা দেখানোর আগে এক দিন ভদ্রলোক ও তার স্ত্রী সজলের বাসায় আসবেন। তারা সারাদিন থাকবেন। দুপুরে আর রাতে তাদের বাসায় খাবেন।
শর্ত ৩ – বাসা ভাড়া পাবে কি না তা দুইমাস পর জানা যাবে।
অদ্ভুত সব শর্ত। কিন্তু সজল শর্ত মানতে রাজি আছে। সজলের চার বছরের একটা মেয়ে আছে। সারিন। তার মানে, প্রথম শর্ত নিয়ে সজলের দুশ্চিন্তা নেই। পরের শর্তগুলোর কথা শুনে আবারো হাসিতে ফেটে পড়ল রীনা।
সজল বলল, “শোনো, বাসাটা যদি পেয়েই যাই, কত বড় একটা সুবিধা হবে ভেবে দেখেছ?”
রীনা হাসি থামিয়ে বলে, “কীসের সুবিধা?”
“আগামী বছর মেয়েটাকে আশেপাশের কোনো স্কুলে দিতে পারব। আর, মেয়েটাকে নিয়ে তুমি বাসা থেকে হেঁটেই স্কুলে যেতে পারবে। মেইন রাস্তা পার হওয়ার কোনো টেনশনও থাকবে না।”
রীনা সায় দিয়ে বলে, “তা ঠিক বলেছ।”
সজল আরও বলে, “এখন আমরা যে বাসায় আছি, তার চেয়ে বাসাটা বেশ বড় হবে। আবার আলাদা গেস্ট রুম, ড্রয়িং রুম।”
“আমার কিচেনটাও নিশ্চয় বড় হবে”, খুশি হয়ে বলে রীনা।
“অবশ্যই বড় হবে। আর ভেবে দেখ, প্রতি মাসে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা সাশ্রয় হবে।”
“দেখো চেষ্টা করে। যদি মিলে যায়।”
“তুমি রাজি থাকলে ওনাদের আগামী শুক্রবার আসতে বলি।”
“ঠিক আছে। বলতে পারো। দুজন মানুষ দুই বেলা খাবে শুধু। আমার আপত্তি নাই।”
“আমি তাহলে ওনাকে এখনই বলে দিই।”
“না, এখনই না বলে বরং বাইরে থেকে হলেও একবার বিল্ডিংটা দেখে আসো। আর সুযোগ পেলে বাসার দারোয়ানের সাথেও কথা বলে আসতে পারো। যদি কিছু খোঁজ খবর পাওয়া যায়। ভুয়া বিজ্ঞাপনও তো হতে পারে।”
সজল রীনার কথায় সায় দিয়ে বলল, “ঠিক বলেছ। আগে একটু খোঁজ নেওয়া প্রয়োজন। একদম অচেনা এরকম মানুষকে বাসায় আনা উচিত হবে না। হঠাৎ একটা অঘটন ঘটে যেতে পারে।”
ঐ দিনই অফিস থেকে ফেরার পথে সজল বাসাটা খুঁজে বের করল। রাস্তা থেকে ফ্ল্যাটের বাইরের অবস্থা দেখেই সে হতবাক। খুব সুন্দর ডিজাইন করা একটা বিল্ডিং। বারান্দাগুলো বেশ মনোরম। দারোয়ানকে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “ভাই, ছয় তলার পূর্ব পাশের ফ্ল্যাটটা কি ভাড়া হবে?”
“আমি বলতে পারব না, স্যার। বাইরে তো টু লেট টাঙানো নাই। বড় লোকের মতিগতি। ভাড়া দিতেও পারে।”
“কারা থাকে ঐ ফ্ল্যাটে তা জানেন?”
“তা জানি স্যার। হাজব্যান্ড ওয়াইফ দুইজন থাকেন।”
আর কোনো কথা না বাড়িয়ে বাসায় ফিরে আসে সজল। রীনাকে সব ঘটনা খুলে বলে। সব শুনে রীনা বলে, “তাহলে তো ঠিকই আছে। অন্তত এটা নিশ্চিত হওয়া গেল যে তারা জেনুইন। অনেকেই আছে এরকম। বাইরে টু লেট টাঙিয়ে ঝামেলা করতে চায় না। ভাবনা চিন্তার আর দরকার নাই। ফোন করে আসতে বলে দাও।”
সজল সাথে সাথে ভদ্রলোককে ফোন করে পরের শুক্রবার তার বাসায় বেড়াতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানাল।
দুই
শুক্রবার অফিস ছুটি থাকায় সজল সাধারণত ঘুম থেকে একটু দেরিতে ওঠে। বেশিরভাগ সময় নয়টা পার হয়ে যায়। সপ্তাহের এই একটা দিনই সে অ্যালার্ম ছাড়া ঘুমাতে যায়।
এই বিশেষ শুক্রবারে, বিশেষ অতিথি আসার দিনে অ্যালার্ম বাজার আগেই কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় রীনার। সজলকে ডেকে উঠায় সে। “কে যেন কলিং বেল দিচ্ছে। উঠে গিয়ে একটু দেখবে নাকি?”
“কাজের খালা মনে হয়।”
“আরে না, খালা আসবে এগারটায়। আর এখন বাজে মাত্র আটটা দশ। তুমি একটু যাও না! আমি উঠলেই সারিন উঠে পড়বে।”
ঘুম ঘুম চোখে কোনোরকমে গিয়ে দরজা খুলে দেয় সজল। অচেনা এক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে। পাশে একজন ভদ্রমহিলা। চেহারা, পোশাক-পরিচ্ছদ, ভাবগাম্ভীর্য সব মিলিয়ে চোর ডাকাত জাতীয় কোনোকিছু ভাবার বিন্দুমাত্র সুযোগ নাই। ভদ্রলোকের হাতে মিষ্টির প্যাকেট। ভদ্রমহিলার হাতেও ছোট একটা প্যাকেট। দেখেই বোঝা যাচ্ছে চকলেট আর চিপসে ভরা। ভদ্রলোক নীরবতা ভাঙলেন, “বাবা, আমার নাম বশির আহমেদ। সাথে আমার স্ত্রী। ফাল্গুনী আহেমদ। এই ঠিকানায় আমাদের আজ বেড়াতে আসার কথা।”
“মিরপুর ৬ এর সি ব্লকের ছয় তলার দুই বেডের ফ্ল্যাট ভাড়া দিতে চান।”
“জি, বাবা।”
“কিন্তু এত সকালে কেন এলেন আপনারা?” এরকম কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায় সজল। দরজাটা পুরো খুলে দিয়ে বলে, “আসুন, ভেতরে আসুন।”
অতিথিদের ড্রয়িং রুমে বসিয়ে রেখে বেড রুমে ঢুকতেই দেখে রীনা উঠে পড়েছে। সাথে ওদের মেয়ে সারিনও। রীনাকে বলে, “তোমার অতিথিরা এসে পড়েছে। দুই বেলার আমন্ত্রণ থাকলেও এখন মনে হচ্ছে তোমার তিন বেলার আয়োজন করতে হবে। আমার তো মনে হয়না তারা সকালের নাশতা খেয়ে এসেছে!”
সারিন বলে, “কে এসেছে মা?”
রীনা বলে, “বাড়িওয়ালার বয়স কেমন?”
“বাবার চেয়ে কিছুটা বেশি হবে মনে হয়।”
সজলের কথা শুনে রীনা সারিনকে বলে, “তোমার এক দাদু আর দিদা এসেছে। আগে ফ্রেশ হয়ে নাও। তার পর ওনাদের কাছে যাবে। দুষ্টুমি করো না যেন মা।”
সারিনকে বিছানায় রেখেই ওয়াশরুমে ঢুকে পড়ল রীনা। সজল আগের রাতের ফুটানো পানি বোতলগুলোতে ঢেলে রাখার জন্য কিচেনে চলে গেল। সারিন সাথে সাথে ছুটে গেল ড্রয়িং রুমে।
রীনা ওয়াশরুম থেকে বের হয়ে সারিনকে বিছানায় না পেয়ে আঁতকে উঠল। অজানা এক আশঙ্কায় কেঁপে উঠল তার মন। দেরি না করে ছুটে গেল ড্রয়িং রুমে। গিয়ে দেখে সারিন ভদ্রমহিলার কোলে বসে চকলেট খাচ্ছে। তার মনে যে ভয় বাসা বেঁধেছিল তা ওনাদের দেখে এক নিমিষেই উড়ে গেল। দুজনকেই সালাম দিয়ে সেও সোফায় বসে পড়ল।
ভদ্রমহিলা বললেন, “আমার দিদা অনেক বুদ্ধিমতী। সে আমাকে তিনটা ছড়া শুনিয়েছে। ওকে কি কোনো স্কুলে দিয়েছ মা?”
“না, এখনও দেওয়া হয়নি। আগামী জানুয়ারিতে ভর্তি করব।”
ভদ্রলোক বললেন, “আমার ছেলে কোথায় গেল মা।”
রীনা ওনার কথা প্রথমে বুঝতে না পারলেও একটু পরেই বুঝল যে উনি সজলের কথা বলছেন। সে বলল, “আপনারা বসেন। আমি দেখছি।” সারিনকে ওনাদের কাছে রেখেই রীনা সজলের কাছে গেল। দুই অতিথির আচার আচরণে সে এতটাই মুগ্ধ যে তাদের প্রতি বিন্দুমাত্র সন্দেহ রইল না তার মনে। রান্না ঘরে গিয়ে সজলকে বলল, “ওদিকে কী ঘটেছে জানো?”
“না, কী হয়েছে?”
“তুমি নিজে গিয়ে দেখে আসো। ড্রয়িংরুমে যাও। গেলেই বুঝতে পারবে।”
সজল সোজা চলে গেল ড্রয়িং রুমে। ভদ্রমহিলার কোলে সারিনকে দেখেই বলল, “ছি, মা! দুষ্টুমি করছ কেন? নেমে আসো। সোফায় বসো।”
‘না, বাবা, থাক না আমার কোলে। আমার দিদা। একদম লক্ষ্মী একটা মেয়ে!”
সজলের মন অন্যরকম একটা ভালোলাগার আবেশে ভরে যায়। “ঠিক আছে, থাক তাহলে। আমরা একসাথে নাশতা করব।”
ভদ্রলোক বললেন, “তোমাদের ব্যস্ত হওয়ার কিছু নাই বাবা। আমরা তো সারাদিন থাকব।”
ওনাদের সারাদিন থাকার কথা শুনে হাততালি দেয় সারিন। সজল চলে যায় রীনার কাজে সাহায্য করার জন্য।
কিছুক্ষণ আগেও যে দুইজন মানুষ একদম অপরিচিত ছিল সজল আর রীনার কাছে, তারাই এখন মনে হচ্ছে কত আপনজন! রীনা গত রাতেও ভেবেছিল যে, কোনোরকমে কিছু একটা রান্না করে এই দুই অতিথিকে বিদায় দেবে। অথচ আজ সেই রীনাই ফ্রিজ হাতড়ে অনেক কিছুই বের করছে। সে তার সেরা রান্নাগুলোর সবই আজ করতে চায়।
সজলও বসে নেই। সেও একটা ব্যাগ হাতে নিয়ে বাজারের পথ ধরে। ভদ্রলোক আর ভদ্রমহিলাকে নিজের বাবা মা থেকে আলাদা করতে একটু কষ্টই হচ্ছে তার।
পাঁচজন মানুষের সারাটা দিন যে কীভাবে কেটে গেল কারও বোঝার উপায় ছিলো না। সারিন তো ওনাদের বিদায়বেলায় কান্নাকাটি জুড়ে দিল। রীনা আর সজলও কোনোরকমে চোখের পানি আটকে রাখল।
রীনার অনুভূতি আর সজলের অনুভূতি কিছুটা আলাদা হলেও এক হিসেবে প্রায় কাছাকাছি। সজলের মা নেই। আর, রীনার বাবা নেই। এই শুক্রবার তাদের জন্য বশির আহমেদ আর ফাল্গুনী আহমেদ শুধু একজন বাড়িওয়ালা আর স্ত্রী নয়, বরং তাদের বাবা মার উপস্থিতি মনে করে দিয়েছিল। সারিন অনেকদিন পর আজ হেসেখেলে টিভি আর মোবাইল ফোন ছাড়া পুরো একটা দিন পার করেছে। সামনে শুক্রবারও এভাবেই কাটবে। কারণ তারা যে ফ্ল্যাট ভাড়া নিতে যাচ্ছে, সেখানে কাটবে সারাটা দিন। বিদায় নেওয়ার আগে দুজনই বার বার করে বলে গিয়েছেন। পরের শুক্রবার সেখানে সময় কাটাতে হবে।
তিন
পরের শুক্রবার সজল, রীনা, সারিন, বশির আহমেদ আর ফাল্গুনী আহমেদ, পাঁচ জনে মিলে আরও একটা বিশেষ দিন পার করল। দুই শুক্রবার বাদ দিয়ে আরও এক শুক্রবার। তার পর আবার। দুই মাস পেরিয়ে গেল। সেপ্টেম্বর মাস চলছে। সারিনের ভর্তি ও বর্তমান বাসা ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কিন্তু এইখানেই বাঁধল চরম বিপত্তি। সজল আকারে ইঙ্গিতে কয়েকবার বশির আহমেদকে ফ্ল্যাট ভাড়ার ব্যাপারে কথা বলেছে। ওনার এক কথা, “আরে বাবা, তোমরা চাইলে আজকেই উঠে পড়ো।”
সজল সাহস করে বলেই ফেলে, “আমরা উঠে পড়লে আপনারা কোথায় যাবেন?”
বশির আহমেদের ভ্রুতে চিন্তার ভাঁজ দেখা যায়। “তাইতো! আমরা কোথায় যাব? তাহলে বাবা, তুমি একটু আমাদের আর কয়েকটা দিন ভাবার সময় দাও।”
“ঠিক আছে। কিন্তু আমাকে দ্রুত একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছতে হবে। কারণ, বাসা ছেড়ে দিলে আগের বাসায় দুই মাস পূর্বে জানাতে হবে। না হলে বাড়িওয়ালার কাছে জমা থাকা দুই মাসের অগ্রিম ভাড়া পুরোটাই গচ্চা যাবে। আবার, সারিনের ভর্তির ব্যাপার আছে।”
“বিষয়টা নিয়ে আমি সিরিয়াসলি ভাবছি। তুমি কোনো চিন্তা করো না বাবা।”
দেখতে দেখতে আরও এক মাস পেরিয়ে যায়। বশির আহমেদের সিরিয়াস ভাবনা আর শেষ হয় না।
এক শুক্রবারে বশির আহমেদকে না জানিয়ে হুট করেই তার বাসায় চলে আসে সজল, রীনা আর সারিন। বাসার দারোয়ান এতটাই পরিচিত হয়ে গেছে যে তাদের আর আটকানোর কথা সে চিন্তাও করেনি।
কলিং বেলের শব্দ শুনে বাসার দরজা খুলে সজলদের দেখে রীতিমত হতবাক হয়ে যান বশির আহমেদ। নিজেকে কোনোরকমে সামলে নিয়ে বলেন, “এসো, ভেতরে এসো।”
তারপরেই ফাল্গুনী আহমেদের দিকে হাঁক ছাড়েন, “কই গো, দেখে যাও, কে এসেছে!”
ফাল্গুনী আহমেদ এগিয়ে আসেন। তার চোখেও একটা অস্বস্তি। তাদের দুজনের অন্যরকম চাহনি সজল আর রীনা কারোরই নজর এড়ায় না। ড্রয়িং রুমে গিয়ে দেখে আরও এক দম্পতি বসে আছে। সারিনের কাছাকাছি বয়সের একটা ছেলে বাসার ভেতরে দৌড়াদৌড়ি করছে।
পরিচয় পর্ব শেষ করে আলাপচারিতার এক পর্যায়ে সজল ভয়াবহ খবরটি পেয়ে যায়। ঐ পরিবারকেও বাসা ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে কথা দিয়েছেন বশির সাহেব। সজলদের মতো তারাও প্রায় মাস দুয়েক এভাবে আসা যাওয়া করছে। রীনার মনটা সবচেয়ে বেশি খারাপ হয়ে যায়। তার কত আশা ছিল সে এই বাসায় উঠবে। দক্ষিণের খোলা বারান্দায় রাতে দুজনে কিছুটা সময় কাটাবে। সব আশা শেষ।
সজলের ভীষণ রাগ হচ্ছে বশির আহমেদের উপর। বাসা ভাড়ার ব্যাপারে আজ একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই ফিরবে এখান থেকে। তাদের জন্য যেহেতু এ বাসার সবকিছু উন্মুক্ত, তাই সে সোজা চলে যায় বশির আহমেদের কাছে। ভদ্রলোক মুখ শুকিয়ে বিছানায় বসে আছেন।
“আমাদের সাথে কেন এই প্রতারণা করলেন?” সজলের প্রশ্ন শুনে তার দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহসও হারিয়ে ফেলেছেন বশির আহমেদ।
“আপনাকে আজ একটা সিদ্ধান্ত দিতেই হবে। হয় বাসা ভাড়া দেবেন নাহয় আজ থেকে আপনার সাথে আমাদের সমস্ত সম্পর্ক শেষ। আমরা এই মুহূর্তে আপনাদের বাসা ছেড়ে চলে যাব।”
সজলের কথা শুনে হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন বশির আহমেদ। ততক্ষণে তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে ফাল্গুনী আহমেদ। তার চোখেও পানি। কান্নার শব্দ শুনে রীনাও চলে এসেছে বেডরুমে। বাচ্চা দুটো নির্বিকারভাবে খেলছে।
ফাল্গুনী আহমেদই মুখ খুললেন, “আমরা ফ্ল্যাট ভাড়া দেওয়ার ব্যাপারে তোমাদের মিথ্যা বলেছি। আমাদের মাফ করে দিয়ো। আমাদের দুই ছেলে আর এক মেয়ের সবাই দেশের বাইরে থাকে। নাতি নাতনীদের জন্মের পর থেকে কখনও সামনা সামনি দেখার সুযোগ হয়নি আমাদের। কারো দশ বছর, কারো আট বছর, কারো সাত বছর, কারো পাঁচ। ছেলেমেয়েগুলোর সাথেও দেখা নাই কত বছর। মোবাইলের স্ক্রিনে ভিডিও কলে দেখা হয়। তাতে কী! মা বলে জড়িয়ে তো আর ধরা যায় না।” একথা বলেই রীনাকে জড়িয়ে ধরেন তিনি। “মা, আমাদের মাফ করে দিয়ো মা।”
রীনা ফাল্গুনী আহমেদের বুকে তার মায়ের স্পর্শ খুঁজে পায়। কিছু একটা বলতে গিয়েও থেমে যায়। মাকে আর মুখ ফুটে বলার কী আছে! মায়েরা তো স্পর্শেই সবকিছু টের পেয়ে যায়।
সজলও বশির আহমেদের কাছে তার বিছানায় বসে অঝোর ধারায় কাঁদতে থাকে।
১২ ডিসেম্বর ২০২২