বই কেনা
ভদ্রমহিলা বুকশপের গ্লাসডোরে জোরে ধাক্কা দিয়ে ভেতরে ঢুকলেন। তারপর সোজা চলে গেলেন ক্যাশ কাউন্টারে। তিনি রীতিমত হাঁপাচ্ছেন। তাঁর হাবভাব দেখে মনে হয় তিনি কোনো ছিনতাইকারীকে ধাওয়া করে দোতলায় চলে এসেছেন এবং যে-কোনো মুহূর্তে বলে বসবেন, ‘কোথায় লুকিয়ে রেখেছ তাকে?’
ক্যাশ কাউন্টারের দায়িত্বে ছিল আসিফ। ভদ্রমহিলাকে দেখে কিছুটা ভয়েই উঠে দাঁড়াল সে।
‘দোকানের মালিক কোথায়?’
প্রায় সাত হাজার স্কয়ার-ফিট এরিয়ার বুকশপকে দোকান বলায় কিছুটা কষ্ট লাগল আসিফের। ভদ্রমহিলার বেশভূষা দেখে তো বেশ শিক্ষিতই মনে হয়। বাংলায় দোকান না বলে ইংরেজিতে ‘শপ’ বলতে পারতেন উনি। তার চিন্তায় ছেদ পড়ে বিকট একটা শব্দে।
‘দোকানের মালিক কোথায়?’
ভদ্রমহিলা এখন একটু কম হাঁপাচ্ছেন। যে কারণে তিনি তাঁর গলার পূর্ণ শক্তি খুঁজে পেয়েছেন। আর সে শক্তির ৯৯.৯৯% প্রয়োগের কারণে সাত হাজার স্কয়ার-ফিট এরিয়ায় যত পাঠক, ক্রেতা, সেলসবয় ও সেলসগার্ল ছিল সবাই ভদ্রমহিলার উপস্থিতি টের পেয়েছে।
কাউন্টারে বসা যুবক কিছুটা হতচকিত হয়ে বলে, ‘মালিক তো এখানে বসেন না।’
‘তাহলে কমপ্লেন দেব কার কাছে?’
‘আমাকে জানাতে পারেন, ম্যাডাম। আমি মালিককে জানিয়ে দেব।’
‘এত বড় দোকান দিতে পেরেছ আর লিফট লাগাতে পারোনি! উপরে আসতে কী অবস্থা হয়েছিল আমার! মরেই যেতে বসেছিলাম। আর একটু হলেই…’
প্রচণ্ড আবেগে তিনি আবার হাঁপাতে শুরু করেছেন। আসিফ ঘাবড়ে গেল। ভাবল, ভদ্রমহিলা মারা যাবে নাকি! হাতের কাছে রাখা পানির বোতলটা এগিয়ে দিয়ে বলল, ‘সরি, ম্যাডাম।’
‘কীসের সরি! আমি নেক্সট টাইম আসার আগেই যেন লিফট রেডি হয়ে যায়। তোমার মালিককে বলে দিয়ো। না হলে …’
ভদ্রমহিলা মাঝপথে থেমে গেলেন। আসিফের মনে হলো, তিনি বলতে চেয়েছিলেন, না হলে আমি আর আসব না। কিন্তু না। তিনি আগের চেয়ে একটু নরম সুরে বললেন, ‘ঠিক আছে। আমার এত কাহিনি করার সময় নেই। আমার সাথে কাউকে দাও। আমি আমার পরিবারের সবার জন্য বই কিনতে চাই।’
ভদ্রমহিলার শেষের কথায় বেশ খুশি মনে হলো আসিফকে। এমন বইপোকা পরিবার আছে এখনও। কেন থাকবে না? এমন পরিবার আছে বলেই তো টিকে আছে এত বড় বুকশপ।
আসিফ চেয়েছিল বুকশপের একজন মেয়েকে ভদ্রমহিলার সাথে দিতে। কিন্তু ওনার গলার আওয়াজে ভয় পেয়ে সব মেয়ে দূরে দূরে ঘুরছে। অগত্যা পাশে থাকা একজন ছেলেকে বলল, ‘অয়ন, ম্যাডামের সাথে যাও। বই দেখাও।’
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর থেকেই অয়ন এখানে পার্ট-টাইম কাজ করে। সাপ্তাহিক ও অন্যান্য ছুটির দিনগুলোতে চার ঘণ্টা করে সময় দেয় সে। তার মূল উদ্দেশ্য টাকা উপার্জন করা নয় বরং বই পড়া। প্রাণভরে নতুন বইয়ের ঘ্রাণ নেওয়া। বইয়ের কাছাকাছি থাকা।
ভদ্রমহিলা আবার সুর উঁচিয়ে আসিফকে বললেন, ‘যে সাথে থাকবে সে যেন বইয়ের ব্যাপারে এক্সপার্ট হয়। না হলে কিন্তু আমি কমপ্লেন দেব।’
ভয়ে অয়নের গলা শুকিয়ে যায়। অনেক চেষ্টা করে মুখ দিয়ে দুটো শব্দ ঠেলে বের করে আনে, ‘আসেন, ম্যাডাম।’
‘প্রথমে ইংলিশ বই দেখাও।’
‘কী বই, ম্যাডাম?’
‘কী বই মানে? তুমি সব বই দেখাও। পরে আমার যেটা পছন্দ হবে সেটা কিনব। দেখেশুনে কেনার জন্যই তো এতদূর এসেছি। নইলে অনলাইনে বাসায় বসেই কিনতে পারতাম।’
অয়ন ভদ্রমহিলাকে নিয়ে একে একে বুকশপের Literary Fiction, Science Fiction, Horror, Romance, Mystery, Fantasy, Poetry, Drama, History, Biography, Photography, Art, Travel, Magazine সেকশন ঘুরে ঘুরে দেখাতে লাগল।
ভদ্রমাহিলার কোনো বই-ই পছন্দ হয় না। একেক বইয়ের একেক সমস্যা তুলে ধরেন উনি।
‘এটার লেখা এত ছোট কেন? পড়তে চশমা লাগবে। চশমার টাকা কে দেবে? তোমরা দেবে?’
‘এটা এত ভারি কেন? এটা পড়তে গেলে হাত ব্যথা হয়ে যাবে। ওষুধ কেনার টাকা কে দেবে?’
‘এটা এত বড় কেন? রাখব কোথায়? এক বই দিয়েই তো পুরো ড্রয়িংরুম দখল হয়ে যাবে!’
‘এটা কী কাগজ দিয়েছে? এত পাতলা! পড়তে গেলে তো পৃষ্ঠা ছিঁড়ে যাবে! ছিঁড়ে গেলে কি তোমরা বই পাল্টে দেবে?’
‘এটার মলাটে এত রং দিয়েছে কেন? যতসব হাবিজাবি রং! কত হাল্কা রং আছে! আমার মেয়েই এর চেয়ে ভালো রং করতে পারে।’
‘এটার দাম এত বেশি কেন? দুইশ পৃষ্ঠার বই, দাম লিখে রেখেছ দুই হাজার টাকা। তার মানে এক পাতার দাম বিশ টাকা। আরে বাবা বিশ টাকা দিয়ে একটা পুরো খাতা কেনা যায়। বই কিনতে যাব কোন দুঃখে!’
ভদ্রমহিলা বইয়ের লেখক বা তার বিষয়বস্তু না দেখে এভাবে শুধু রং, ওজন, আকার, কাগজের মান ইত্যাদি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। অয়নের অস্বস্তি লাগছিল। ভদ্রমহিলার কথার কারণে নয়। অন্য একটা কারণে। ওনার পারফিউমের গন্ধে বইয়ের চিরচেনা গন্ধগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে ফেলছিল সে।
অয়ন বলল, ‘ম্যাডাম। ইংরেজি বইগুলো দেশের বাইরে থেকে আসে। ওগুলোর দাম সাধারণত একটু বেশিই হয়। আপনি বরং বাংলা বই দেখেন।’
ভদ্রমহিলাকে দেখে মনে হলো উনি একটু অসন্তুষ্টই হলেন। অয়ন একটু ঘাবড়ে গেল। হয়তো উনি বলেই বসবেন, ‘তোমার কী মনে হয় আমাকে দেখে? আমি ইংলিশ বই পড়তে জানি না?’ কিন্তু না, উনি চুপ করে আছেন এটাই সুখের কথা । অয়ন বলল, ‘বাংলা কী বই কিনবেন ম্যাডাম?’
ভদ্রমহিলা ঠিক আগের কথাই বললেন, ‘কী বই মানে ? তুমি সব বই দেখাও। পরে আমার যেটা পছন্দ হবে সেটা কিনব।’
তবে তার গলার স্বর আগের চেয়ে কিছুটা নিচু।
অয়ন তাঁকে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল সেকশনে নিয়ে গেল। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘ওদের লেখা তো স্কুলের পাঠ্যবইয়েই আছে। আমি স্কুলকলেজে থাকতে পড়েছি। আমার ছেলেমেয়েরা এখন পড়ে। প্রতি ক্লাসেই ওদের গল্প-কবিতা আছে। বাচ্চাদের পড়ানোর সময় এখনও পড়ি। তুমি অন্য কারও বই দেখাও।’
এরপর হুমায়ূন আহমেদের সেকশন দেখালো। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘এসব বইয়ের নাটক-সিনেমা আছে। কোনোটাই দেখার বাকি নাই। সব কাহিনি আমার মুখস্থ। নতুন কিছু দেখাও।’
অয়ন তাঁকে রান্নার বইয়ের সেকশনে নিয়ে গিয়ে ভাবল, এবার কাজ হবে। কিন্তু তাকে নিরাশ করে ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি কত ধরনের রান্না জানি তোমার কোনো আইডিয়া আছে? নাই। আমি বই লিখলে এরকম একশটা বই লিখতে পারব। আর কিছু আছে?
অয়ন এবার সাহস করে বলেই বসল, ‘ম্যাডাম, আপনি আসলে কার কার জন্য বই কিনবেন? আর কয়টা বই কিনবেন? দয়া করে আমাকে একটু খুলে বলেন। তাহলে আমি আপনাকে সেভাবে বই দেখাতে পারব।’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমার বাসায় মোট ছয়জন মানুষ আছে। আমি, আমার হাজবেন্ড, আমার দুই ছেলে – একজন ক্লাস টেনে একজন ক্লাস এইটে, ক্লাস ফাইভে পড়া এক মেয়ে, আর আমার শাশুড়ি। সবাই পড়তে পারে এমন বই কিনব।’
‘কয়টা বই?’
‘একটা।’
‘মানে প্রত্যেকের জন্য একটা করে?’
‘না, সবার জন্য একটা।’
অয়ন এতক্ষণে ভদ্রমহিলা সম্পর্কে একটা ধারণা পেয়ে গেছে। একটু ইতস্তত করলেও শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞাসা করেই বসল, ‘আপনি কি মুসলমান?’
‘হ্যাঁ, কিন্তু কেন?’
অয়ন তাঁর প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে তাঁকে কুরআন-হাদিস সেকশনে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘ম্যাডাম, আপনি বরং একটা কুরআন শরীফ নেন। বাসার সবাই মিলে পড়তে পারবেন।’
কোনো ইভেন্টে জিতে গেলে মানুষ যেভাবে হাসে, মহিলা সেরকম একটা হাসি দিয়ে বলল, ‘আমরা সবাই নামায পড়ি। অনেক সূরা আমাদের মুখস্থ আছে। তুমি শুনতে চাইলে আমি তোমাকে এক্ষুনি শোনাতে পারি।’
অয়নের অবস্থা একদম কাহিল। এক বছর ধরে এখানে সেলসবয়ের কাজ করছে। এরকম কারও পাল্লায় আগে কখনও পড়েনি সে। শেষ চেষ্টা হিসাবে এবার ভদ্রমাহিলাকে একটি বাংলা একাডেমীর ডিকশনারি দেখিয়ে বলল, ‘এটা নিয়ে যান। সবাই মিলে পড়তে পারবেন। ম্যাডাম!’
ভদ্রমহিলা কিছুক্ষণের জন্য চুপ করে থাকল। অয়নের মনে হলো, এবার কাজ হয়েছে। কিন্তু না। ভদ্রমহিলার মুখে আবারও জিতে যাওয়ার হাসি। বললেন, ‘ডিকশনারির জন্য বই কিনতে যাব কোন দুঃখে? মোবাইল অ্যাপ আছে আমার। ইংলিশ টু বাংলা।’
তিনি তাঁর ব্যাগ থেকে মোবাইল ফোন বের করে অয়নকে অ্যাপটা দেখালেন। বললেন, ‘একটা ইংলিশ ওয়ার্ড বোলো। আমি এখনই তোমাকে তার মিনিং বলে দিচ্ছি।’
‘না ম্যাডাম। দেখাতে হবে না। আমি জানি। এটা বইয়ের চেয়ে ভালো। কারণ বই সবসময় হাতে নিয়ে ঘোরা যায় না। আর বইয়ে খুঁজে বের করাও একটা ঝামেলা।’
ভদ্রমহিলা আবার হেসে উঠলেন। বললেন, ‘তাহলে বুঝে নাও আমার বই কেনার প্রসেস। তুমি আমাকে দিয়ে যা তা বই কেনাতে পারবে না। এত সহজ নই আমি।’
অয়ন ইতোমধ্যে বুঝে ফেলেছে ভদ্রমহিলাকে দিয়ে বই কেনানো আসলেই কঠিন। প্রায় এক ঘণ্টায় ওরা সবগুলো সেকশন ঘুরে ক্যাশ কাউন্টারের কাছে এসে পড়েছে। ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আজকে তো অনেক দেখলাম। পছন্দ হলো না। সমস্যা নেই। আরেকদিন আসব। সবাইকে নিয়ে। তবে সেদিন যেন লিফট পাই আমি। নাহলে নিচে থেকেই ঘুরে যাব। বই কেনার জন্য কিন্তু সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে পারব না।’
কাউন্টারে বসা আসিফ মৃদু হেসে বলল, ‘ঠিক আছে ম্যাডাম। আমরা চেষ্টা করব। আমরা আপনার মতো কাস্টমারকে হারাতে চাই না।’
আসিফের কথায় ভদ্রমহিলা খুশি হলেন। ‘এরপর যেদিন আসব সেদিন আমার সাথে অন্য কাউকে দিয়ো। আরেকটু এক্সপার্ট হলে ভালো হয়। বইয়ের ব্যাপারে যে আরও ভালো করে বুঝাতে পারবে।’
আসিফ বলে, ‘অবশ্যই ম্যাডাম। আপনার সাথে যায় এরকম কাউকেই দেব। দরকার হলে তাকে বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে রাখব।’
ভদ্রমহিলা সন্তুষ্টির হাসি মুখে নিয়ে চলে গেলেন। তিনি গ্লাসডোর ঠেলে বাইরে বের হবেন ঠিক তখনই অয়ন দৌড়ে ছুটে গেল তাঁর কাছে। একটা পাতলা বই তাঁর হাতে দিয়ে বলল, ‘এটা নিয়ে যান ম্যাডাম। একদম ফ্রি।’
‘কী এটা?’
‘এটা একটা ক্যাটালগ। আমাদের এখানে যত বই আছে তার তালিকা। আপনি আপনার পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বাসায় বসেই বই পছন্দ করতে পারবেন।’
‘আমাকে বোকা পেয়েছ? আমি না জেনে, না দেখে, না বুঝে, শুধু নাম দেখে কিছু কিনি না। আমি আবার আসব।’
ভদ্রমহিলা বাইরে যেতেই অয়ন ক্যাটালগটা কাউন্টারের পাশে রেখে একটা বই হাতে নেয়। তার পর বইটা মেলে ধরে দুই পৃষ্ঠার মাঝে নাক ডুবিয়ে প্রাণভরে শ্বাস নেয়। মনে মনে বলে, ‘আহ ! শুধু এই গন্ধটার জন্যই নতুন একটা বই কেনা যায়। যে-কোনো বই !’
(প্রথম প্রকাশ- গল্পকার, সেপ্টেম্বর ২০২২)