পাখিদের ভাষা জানে যে-লোক
এক
পাখিদের ভাষা জানে যে-লোক তাকে আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ একনামে চেনে। তার নাম মোসলেম পাগলা। ত্রিশ পেরোনো এই লোকটা এক নিমিষেই যে-কোনো গাছের মগডালে উঠে বসতে পারে। পাখির সাথে গল্প করার নেশায়। পাখির খোঁজে গাছে-গাছে আর ঝোপঝাড়েই কাটে তার বেশিরভাগ সময়। যার প্রভাব পুরোটাই পড়েছে তার শরীরে। মেদহীন শরীরটা ঢেকে রেখেছে যে-চামড়া, তার কোনো জায়গাতেই কাটা-ছেঁড়ার অভাব নেই। এর কোনোটা একদম টাটকা, কোনোটা দু’-তিন দিনের পুরোনো, কোনোটা আবার সপ্তাহ পেরিয়ে চামড়ার উপর কালো রেখার মতো হয়ে আছে। দাঁড়ি-গোঁফ কামানো হয়নি অনেকদিন। লালচে একটা আভা পড়েছে। জট ধরেছে মাথার চুলে। সবকিছুতেই একটা আদিম, শিকারি ভাব আছে। তবে তার মলিন চেহারা ঢাকা পড়েছে পাখির মতো চকচকে চোখে।
মোসলেম পাগলা পারহাট গ্রামে এসেছিল আট-নয় বছর বয়সে। অষ্টাশি সালের বন্যার বছর। চারিদিকে তখন বানের পানিতে থইথই। এই পানিতেই ভেসে আসে মোসলেম। পারহাট গ্রামের পাঠশালার মাস্টার, রজব আলী সকালবেলা গোসল করতে গিয়ে পুকুরের পাশে বানের পানিতে ডুবে যাওয়া ফসলের জমিতে ভাসতে দেখেন একটা ছেলেকে। লাশের মতো ভেসে আসা শরীরে কোনো কাপড় ছিল না। জ্ঞান ফেরার পর অনেক কষ্ট করেও তার মুখ থেকে কোনো কথা বের করা গেল না। ধরে নেওয়া হলো, সে বোবা।
বোবা ছেলেটাকে কী করা হবে, কোথায় রাখা হবে, সবাই যখন এসব বিষয় নিয়ে চিন্তিত, তখন রজব আলীর চোখে ভেসে ওঠে ছেলেটার নগ্ন, ফর্সা দেহ। ভেসে ওঠে পুকুরের পাশে একাকী দাঁড়িয়ে থাকা মাটির ঘর। তার একাকীত্ব। নিঃসঙ্গ রাত। নিষিদ্ধ কামনা। রজব আলী নিজেও বোঝেন, তিনি যা ভাবছেন তা পাপ। মহাপাপ। কিন্তু শরীর তো আর বাধা মানে না। অবাধ্য শরীর মাঝেমধ্যেই মিলিয়ে দেয় পাপ আর পুণ্যের সীমারেখা। বিগড়ে দেয় জীবনের সরল হিসাব। তাইতো একরকম নির্দ্বিধায় হার মেনে নিয়ে নিজেকে সান্ত্বনা দেন এইভেবে যে, তিনি তো আর ফেরেশতা নন, মানুষ। পাপ তার হবেই। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন, “আরে মিয়ারা, এত চিন্তা করার কী আছে? সে মুসলমানের ছেলে। তার খৎনা করা আছে। আমি দেখেছি। তোমরা কেউ না নিলে আমার কাছেই থাকবে সে।” রজব আলী ছেলেটার নাম দেন মোসলেম। তার আশ্রয়ে থাকবে জেনে গ্রামের সবাই নিশ্চিন্ত হয়। রজব আলীরও একটা বড় উপকার হয়। তার নিঃসঙ্গ জীবনে একটা সঙ্গী জোটে।
রজব আলীর মাটির ঘরে আশ্রয় মিলল মোসলেমের। প্রায় একইভাবে রজব আলীরও আশ্রয় মিলেছিল এই গ্রামে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরের বছর। নিজ গ্রাম হতে কোনো এক অজানা কারণে স্বেচ্ছায় নিরুদ্দেশ হয়ে পথে পথে ঘুরে শেষে ঠাঁই মেলে এই পারহাট গ্রামে। প্রথমে তালুকদার বাড়িতে। জায়গির হিসাবে। ছোট বাচ্চাদের পড়ানোর কাজ। শুদ্ধ বাংলায় কথা বলার কারণে খুব অল্প সময়ে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে সারা গ্রামে। সুযোগ পেলেই গ্রামের লোকজন তার সাথে কথা বলে, তার কাছে শুদ্ধ করে কথা বলার টেকনিক শিখতে চায়। গ্রামের মানুষের কথা ভেবে তালুকদার সাহেব ছোট একটা পাঠশালা করে দেন গ্রামে। পাঠশালা বলতে একটা মাটির ঘর। সব বয়সীদের জন্য। মাস্টার ঐ একজনই। রজব আলী।
রজব আলী তালুকদার বাড়িতে পড়ানো শেষ করে সকালবেলা গ্রামের বাচ্চাদের পড়ান ঘণ্টাখানেক। বিকেলে গ্রামের বয়স্ক মানুষেরা পড়তে আসে তার পাঠশালায়। বাকি সময়টা কাটে মাটির ঘরের ভেতর শুয়ে বসে। ঘরে কোনো জানালা নেই। ছোট একটা কাঠের দরজা। দরজা বন্ধ করলেই রাতের অন্ধকার নেমে আসে ঘরে। অন্ধকারে থাকতেই ভাল লাগে রজব আলীর। বিদ্যুতের আলো তখনও পৌঁছায়নি ঐ তল্লাটে। রাতে খাওয়ার আগে হারিকেন জ্বালান। অন্যসময় যে-কোনো প্রয়োজনে বিছানায় থাকা পাঁচ-ব্যাটারির টর্চলাইটেই কাজ সারেন। রজব আলীর ঘরের ভেতর ছোট একটা চৌকি। তার পাশে একটা ছোট টেবিল। টেবিলের উপরে তিন বেলা খাবার জমা হয় । ভাত-তরকারি ছাড়াও মাঝে মধ্যে অন্য খাবারও আসে। অনেকেই দরজার কাছে এসে বলে, “স্যার, ভাত আনচি, লাইট জ্বলান।” অনেকে আবার অন্ধকারেই খাবার রেখে যায়। কোথায় রজব আলীর চৌকি, কোন দিকে মুখ করে তিনি শুয়ে থাকেন, কোথায় খাবারের টেবিল, সব মুখস্থ। পাঠশালার মাস্টার বলে কথা। রজব আলীর সেবা করে অনেকেই শান্তি পায়। তারও ভালো লাগে সেবা নিতে। ভালোবাসে বলেই তো গ্রামের মানুষ তার এত সেবা করে। তিনিও ভালোবাসা দিয়েই তার প্রতিদান দেন।
ভালোবাসার এসব দান-প্রতিদানের মাধ্যেই রজব আলীর ঘরে মেয়েমানুষদের খাবার দিতে আসা, তাদের আনাগোনা নিয়ে গ্রামে নানান কথা চলতে থাকে। এসব কথা চাপা দিতে রজব আলীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য মেয়ে দেখাও শুরু করেন তালুকদার সাহেব। কিন্তু রজব আলীর অনাগ্রহে তাঁর উৎসাহে ভাটা পড়ে। “পাঠশালার ছেলেমেয়েরাই আমার সন্তান, আমার সংসার।” রজব আলীর এমন কথার পরে আর কথা থাকে না। তার বিয়ের প্রসঙ্গ চাপা পড়ে যায়।
দুই
রজব আলীর সাথে প্রায় এক বছর কাটিয়েছিল মোসলেম। কাটানো বলতে শুধু ঐ রাতটুকু। মোসলেম সকালের খাবার খেয়ে ঘর থেকে বের হয়ে যেত। দুপুরে যদি অন্য কোথাও খাবার মিলত তাহলে ঘরে ফিরত ঠিক ঘুমানোর আগে। কোনো কোনো দিন তার মনে হতো সে ঘরেই ফিরবে না। বাইরে কোথাও ঘুমাবে। কিন্তু রজব আলীর টর্চলাইট ঠিকই খুঁজে বের করত তাকে। বাধ্য হয়েই ফিরতে হতো। আর রজব আলী তাকে কোল বালিশ বানিয়ে দুই পায়ের চিপায় ফেলে ঘুমাত, যাতে সে আর পালাতে না পারে। চিপায় পড়ে মাঝেমধ্যেই লুঙ্গি খুলে যেত মোসলেমের। গ্রামের একছেলের কাছ থেকে হাফপ্যান্ট ধার করে পরেছিল সে একবার। রজব আলী ঐ রাতেই তার প্যান্ট ছিঁড়ে পুকুরের পানিতে ফেলে দিয়ে তাকে ন্যাংটা করে পায়ের চিপায় ফেলে রেখেছিল সারা রাত। এই ঘটনার পর সে আর কখনও রজব আলীর কোনও কাজে প্রতিবাদ করার সাহস পায়নি।
একদুপুরের ঘটনা। বর্ষার একটানা বৃষ্টি। বাইরে কোথাও খাবার না পেয়ে ঘরে ফেরে মোসলেম। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখে অবাক করা জিনিস। রজব আলী চৌকির উপর খালি গায়ে এক মেয়েমানুষের উপর শুয়ে আছে। এরকম উদাম হয়ে তার উপরও মাঝে-মাঝে শুয়েছে রজব আলী। তবে, তফাৎ হলো, মোসলেম উল্টো দিক হয়ে পা দুটো যথাসম্ভব চেপে রেখে বালিশে মুখ গুঁজে থাকে, আর মেয়েমানুষটা তার পা দুটো ফাঁকা করে রজব আলীর দিকে মুখ করে আছে। মোসলেম মেয়েমানুষটাকে এক বার দেখে। তারপর আরেকবার। আরেকবার। পা তার আটকে গেছে কোনো এক অদৃশ্য জালে।
রজব আলী চৌকি থেকে নেমে আসে। ঘুণাক্ষরেও ভাবেনি এই বৃষ্টির মধ্যে মোসলেম ফিরে আসবে বা অন্য কেউ ঢুকবে ঘরে। মোসলেমকে কিছু না বলে গামছা হাতে বৃষ্টির মধ্যেই বাইরে চলে যায় রজব আলী। পুকুরের দিকে। মেয়েমানুষটাও উঠে বসেছে। এখনও কাপড় খুঁজে পায়নি তার। মোসলেম তখনও অবাক হয়ে চেয়ে আছে তার দিকে। চৌকির নিচে পড়ে যাওয়া কাপড়গুলো তুলে নিয়ে দ্রুততার সাথে পরে নেয়। মোসলেম শ্বাস বন্ধ করে তার কাপড় পরাও দেখে। কাপড় পরা শেষ করে মেয়েমানুষটা তার কাছে এসে হাঁটুর উপর ভর দিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। দুই গালে চুমু দিয়ে বলে, কাকু কস না যান, আচ্চা। তোক পোত্তেক দিন ভাত খাওয়ামো।” মোসলেম মাথা নাড়ে। তার কথা রাখবে সে। না রেখে কী উপায় আছে! রজব আলীর জাপটে ধরা আর এই মেয়েমানুষটার জড়িয়ে ধরার মাঝে যে আকাশ-পাতাল তফাৎ!
ঐদিন দুপুরের আগেই একটা খবর ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে। মোসলেমের মুখ খুলে গেছে। কথা বলছে সে। একটু অস্পষ্ট হলেও বোঝা যাচ্ছে তার কথা। রজব আলী বিকেলে পাঠশালায় বসেই কথাটা শুনতে পান। তার পর থেকে পারহাট গ্রামে তাকে আর দেখা যায়নি কখনও। একেবারে উধাও, যেমনটা নিজ গ্রাম থেকে হয়েছিলেন। রজব আলী মাস্টার হঠাৎ করে কোথায় গেলেন, কেন গেলেন, কবে ফিরবেন, আদৌ ফিরবেন কি না, কোনও প্রশ্নেরই উত্তর মিলল না। মোসলেম কথা বলতে শুরু করলেও রজব আলীর অন্তর্ধান বিষয়ে তার কোনো কিছু জানা নেই, কোনো কথা নেই, কোনো ব্যাখ্যা নেই, কোনো ভাষা নেই।
তিন
মাটির ঘরটা কিছুদিন মোসলেমের থাকলেও পাঠশালায় নতুন মাস্টার আসার পরপরই ছেড়ে দিতে হল তাকে। তবে ঘরছাড়া হয়ে একদিনও থাকতে হয়নি তাকে। গ্রামের পাঠশালা থেকে কয়েকশ গজ পশ্চিমে গিয়ে বড় পুকুরের পাশেই একটা পরিত্যক্ত ঘরে থাকার জায়গা পেল সে। খাবার নিয়েও চিন্তা করতে হত না। মজিরন বিবি তার কথামতো ঠিকই খাবার দিয়ে যেত। আর কোনো দিন সে না এলে, পাখিরা যেমন ঘুরেফিরে খাবারের ব্যবস্থা করে, মোসলেমেরও তেমনি কোনো না কোনো-ভাবে ব্যবস্থা হয়ে যেত। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত তার একটাই কাজ। সারা গ্রাম ঘুরে বেড়ানো। তার সবচেয়ে প্রিয় জায়গা হল গ্রামের বিশাল পুকুরটির চারপাশের ঝোপঝাড় আর আম, জাম, কাঁঠাল গাছের সারি। সাপ, বেজি, জোঁকের ভয়ে মানুষ যেখানে যাওয়ার কথা চিন্তাও করে না, সেখানেই পাওয়া যায় মোসলেমকে। পুকুরে স্নান করতে করতে ঝোপের মধ্যে হঠাৎ কিছু নড়ে উঠলে অনেকেই গুইসাপ ভেবে পুকুর থেকে কাদা তুলে ছুঁড়ে মারে। কিছুক্ষণ পর হয়তো দেখা যায় মোসলেম ঝোপ থেকে বের হয়ে গুইসাপের মতো ঝুপ করে পুকুরের পানিতে নেমে পড়ে।
“জঙ্গলের মদ্যে কী করিস?” এমন প্রশ্নের উত্তরে একটাই শব্দ বের হত মোসলেমের মুখে , “পাকি দেকি, পাকি।”
আবার হয়তো দেখা গেল, ভর দুপুরে পুকুরের পাশে একটা কাঁঠাল গাছে চুপটি করে বসে আছে মোসলেম। “ক্যারে মোসলেম, গাচত কী করিস? ক্যাবল তো কাঁটাল ধরা আরম্ভ হচে। অ্যাকনি খাবু নাকি?”
উত্তরে শোনা যাবে, “পাকি দেকি, লয়া পাকি।”
গরমের রাতে যখন মানুষ উদাম গায়ে ঘরের জানালা খুলে ঘুমায়, তখন ভোরের আবছা আলোয় মোসলেমকে দেখা যায় কারো ঘরের জানালায় বসে আছে।
কেউ দেখে ফেললে প্রশ্ন করে, “এ মোসলেম, জানলাত বস্যা কী করিস?”
“পাকি ঢুকচে ঘরের মদ্যে।” মোসলেমের নির্লিপ্ত উত্তর।
সারা দিন ভবঘুরের মতো ঘোরার কারণে মোসলেমের নাম হয়ে যায় ‘মোসলেম পাগলা’। কৈশোর পেরিয়ে যুবক হলেও পাগলা উপাধি রয়ে যায়। পাখিদের পেছনে ঘুরতে ঘুরতে, পাখিদের সাথে থাকতে থাকতে, পাখিদের দেখতে দেখতে মোসলেম একদিন শিখে যায় পাখিদের ভাষা। অবশ্য, তার এই গুণের কথা অজানাই ছিল সবার। একদিন এমন এক ঘটনা ঘটে যায়, যাতে সবাই জেনে যায়, মোসলেম পাগলা পাখির ভাষা জানে।
ঘটনাটি ছিল এমন। গ্রামের তালুকদার বাড়ির বউ পরীবানু পুকুরের পাড়ে শুকনো কাপড় আর গামছা রেখে গোসলে নামে। গোসল সেরে দেখে তার কাপড় নেই। এখন ভেজা কাপড়ে বাড়ি ফিরবে কী করে? ঐ সময় পুকুর ঘাটে কেউ না থাকায় অনেকক্ষণ ধরে পানিতেই থাকে সে। পরে আরেকটা মেয়ে পুকুরে গোসল করতে গেলে পরীবানু তাকে সব খুলে বলে। শেষে বাড়ি থেকে আবার কাপড় এনে তার পর রক্ষা।
ঘটনার এখানেই শেষ নয়। রাতে বিচার বসে। তালুকদার বাড়ির বউ বলে কথা। কার এত সাহস যে তালুকদার বাড়ির বউয়ের কাপড় লুকিয়ে রাখে? সন্দেহের তালিকায় এক নম্বরে থাকা নুরুকে বাঁধা হয় একটা গাছের সাথে। পরীবানুর দেয়া তথ্য অনুযায়ী নুরুর কাজ হতে পারে এটা। নুরু ইদানিং তালুকদার বাড়ির আশেপাশে ঘোরে। আর পরীবানু যখন গোসলে বের হয়, তখন তার নুরুর সাথে দেখা হবেই। গোসল সেরে ফেরার পথেও দেখবে নুরু দাঁড়িয়ে আছে গলিতে। আকরাম তালুকদার এ রকম দু-একটা তথ্য দিতেই কয়েকজন চড়াও হয় নুরুর উপর। কেউ চড়-থাপ্পড় দেয়। কেউ লাথি মারে। কেউ আবার পায়ের স্যান্ডেল দিয়ে বাড়ি মারে। মোসলেমের দয়া হয়। ভাবে, বিনা কারণে লোকটা মার খাচ্ছে। সে হাত উঁচু করে দাঁড়ায়। আকরাম তালুকদার বলে, “কিরে মোচলেম, তুই কিচু কবু নাকি?”
মোসলেম পাগলা মাথা নাড়ে।
“পাগলার আবার কি কওয়ার আচে?” খেঁকিয়ে ওঠে ইউপি মেম্বার সোহেল প্রামানিক। চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ায়।
আকরাম তালুকদার মেম্বারের হাত ধরে বসিয়ে দেয়। “থামো মিয়া। অক কবার দ্যাও।” তার পর মোসলেমের দিকে ইশারা করে তাকে কাছে যেতে বলে। মোসলেম আকরাম তালুকদারের পাশে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ে। ফিসফিস করে বলে, “কাল সকালে কওয়া পারমো কে করচে এই কাজ। পাকির থাক্যা শোনমো কাল। অ্যাকন অরা ঘুমাচ্চে।”
আকরাম তালুকদার চিৎকার করে ওঠে, “হামার সাতে ইয়ারকি করো মিয়া। পাকির সাতে কতা কব্যা? তোমার মুক দিয়া যাতে আর কতা না বার হয় সেই ব্যবস্তা করিচ্চি, থামো।” রাগে তার পুরো শরীর কাঁপতে থাকে।
“হামাক সকাল পর্যন্ত টাইম দেন। তার পচে যা ইচ্চা করেন।”
“ঠিক আচে। কাল লয়টার মধ্যে হামাক কওয়া লাগবে কী হচে। না হলে তোমার জবান আগের মতো লাই হ্য়া যাবে, এই কতা মনত থুয়ো ।”
পরদিন সূর্য ওঠার পরপরই ঘটনা জানা গেল। পাখিদের কথা অনুযায়ী মোসলেম পাগলা পুকুরের এক কোণা থেকে পরীবানুর কাপড় বের করে দিল।
আকরাম তালুকদার বলল, “কাপড় কে লুক্যায়া থোচে তোমার পাকি দ্যাকেনি ?”
“দেকচে। কুনু মানুষ লুকা থোইনি। বাতাস উড়া লিয়া পানিত ফাল্যা দিচে।”
এই ঘটনার এখানেই শেষ।
তবে এর পর থেকেই শুরু হয় পাখির সাথে মোসলেমের কথা বলার ঘটনা। গ্রামের অনেক গোপন ঘটনার কথা জানা যায় মোসলেমের কাছ থেকে। মোসলেম পাখিদের সাথে কথা বলে জেনে নেয় আসল ঘটনা। তারপর তার বিবরণ দেয় গ্রামের মানুষের কাছে। আদুরির স্বামী বিদেশ থেকে ফেরার পর গ্রামে সালিশ ডাকে। আদুরির কোলের বাচ্চার বাবা সে নয়। আদুরির বাচ্চাটা তাহলে কার? আদুরি একদম চুপ। গ্রামের সবার মধ্যে এ বিষয়ে কানাঘুষা থাকলেও খুঁজে বের করার দায়িত্ব পড়ে মোসলেম পাগলার ঘাড়ে। মোসলেম এক দিনের সময় নেয়।
পরদিন সালিশে সে বলে, “পাকি হামাক কচে, বাচ্চা মজু পরামানিকের।” সালিশ শেষ হতে বেশি সময় লাগে না। মজু পরামানিককে দুই-চারটা চড়-থাপ্পড় দিতেই সে সবকিছু স্বীকার করে। স্বীকার না করে উপায় কী! এ তো আর মানুষের কথা না! পাখির কথা! আর যাই হোক, পাখি তো আর মিথ্যা বলবে না। পাখিরা সব দেখে। পাখিদের চোখ দিয়ে মোসলেম পাগলাও দেখে। ধীরে ধীরে মোসলেমের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে-গঞ্জে, হাট-বাজারে।
বছর দশেক আগে আটানব্বই সালের বন্যার সময় মোসলেমের ঘরের পাশেই পুকুরের পানিতে ডুবে মজিরন বিবির স্বামী মারা যায়। সকালবেলা পুকুরে লাশ ভাসতে দেখে সবাই মোসলেমকে ধরে এই রহস্যের কিনারা করার জন্য। মোসলেম সময় নেয় এক দিন। তার পর আরও এক দিন। আরও এক দিন। এভাবে সপ্তাহ পেরোনোর পর এক বিকেলে বলে, “আজ পাকির সাতে কতা কচি। আতের বেলা মাচ চুরি করবার গেচলো। মাছ্যা দেও আগ করচে, তাই পানির মদ্যে খুসা খুসা মারচে।”
একজন বলে ওঠে, “মোচলেম ঠিক কতা কচে। আতের বেলা হামিও শুনচি। ওরে বাপরে, দেওয়ের কী দাপাদাপি !”
আরেকজন বলে, “তুমি আত্রে পকরত যাব্যা, আর দেও তোমাক চুম্যা খাবি ?”
আর কোনও প্রমাণের প্রয়োজন পড়ে না। মোসলেমকে বাহবা দেয় সবাই। শুধু মজিরন বিবির কান্না থামে না। পাঁচ বছরের একমাত্র মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে।
এর পরের ঘটনা আরও অদ্ভুত। গ্রামের এক মহিলা তার ছোট বাচ্চাকে পুকুরের পাড়ে বসিয়ে রেখে গোসল করতে নামে। বাচ্চাটা কখন যে হামাগুড়ি দিতে দিতে পুকুরের কাছে এসে পানিতে পড়ে গেছে, সে দেখতেই পায়নি। মোসলেম পাগলা ছুটে এসে তাকে পানি থেকে তুলে ফেলায় বেঁচে যায় বাচ্চাটা।
সবাই হতবাক। সবাই ঘটনাটা জানতে চায় মোসলেম পাগলার কাছে। মোসলেম হাঁপাতে হাঁপাতে বলে, “অ্যাক মাচরাঙা পাকি হামার ঘরের দরজাত যায়্যা হামাক কচে এক ছ্ল পানির দিকে যাচ্চে। হামি দৌড়া আসতে আসতে দেকি ছ্ল পানিত পড়্যা গ্যাচে। সাতে সাতে অক টান্যা তুলচি।”
কে একজন বলে ওঠে, “লায়ক ফেল।” আসলেই তাই। এ রকম ঘটনায় মোসলেম পাগলার কাছে সিনেমার নায়ক হার মানে। গ্রামের মানুষের কাছে সে একজন নায়ক, সবার হিরো।
চার
একদিন মোসলেম পাগলার জন্য গাড়ি করে সাংবাদিকরা আসে ঢাকা থেকে। তাদের সাথে আসে বড় বড় ক্যামেরা। পাখির ভাষা জানা যে-লোক, তার ব্যাপারে রিপোর্ট হবে টিভি চ্যানেলে। এই খবর ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশের গ্রামে। সেসব গ্রাম থেকেও লোকজন এসে ভরে যায় পারহাট গ্রাম। কেউ মাঠে দাঁড়িয়ে থাকে, কেউ পুকুরের পাড়ে, কেউবা আবার গাছে উঠে বসে। সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে মোসলেম পাগলার পাখির সাথে কথা বলার কাহিনি।
মোসলেম পাগলাকে আনা হয় সাংবাদিকদের সামনে। পরনের পোশাকে তার বেহাল দশা, কতক জায়গায় ছেঁড়া, যেটুকু অবশিষ্ট আছে, তাতে ময়লার স্তূপ জমে পাতলা কাপড়কে মোটা করে ফেলেছে। তার বেশভূষা দেখেই সাংবাদিকদের চোখে অবিশ্বাসের ছায়া পড়ে। মোসলেমকে পরীক্ষা করার জন্য তার অজান্তে পুকুরের এক পাড়ে ঝোপের মধ্যে একটা জিনিস ফেলে রাখা হয়। পাখিরা যাতে জিনিসটা দেখার সময় পায়, সেজন্য প্রায় পনেরো মিনিট অপেক্ষা করা হয়। তার পর তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, “কী রাখা হয়েছে পুকুরের পাড়ে ঝোপের মধ্যে?” পাখির সাথে কথা বলে তাকে জানাতে হবে। তাহলেই সে পাস। সারা দেশ জেনে যাবে পারহাট গ্রামে একজন লোক আছে যে পাখিদের ভাষা জানে, পাখিদের সাথে কথা বলে, পাখিদের চোখে চোখে রাখে সারা দিন, ভোর হতে সন্ধ্যা পর্যন্ত।
মোসলেম এদিক-ওদিক ঘোরে, গাছে ওঠে, ঝোপের মধ্যে ঢোকে, কিন্তু কিছুই বলতে পারে না। সাংবাদিকরা অধৈর্য হয়ে ওঠে। গ্রামের লোকজনের মাঝে অস্বস্তি দেখা দেয়। আশেপাশের গ্রামের মানুষের উৎসাহে ভাটা পড়ে। মোসলেম চোখ বন্ধ করে কী যেন ভাবে, তারপর বলে, “পাকি কিচুই দ্যাকেনি। অ্যাতো মানুষ থাকলে পাকি আসে নাকি?” তার গলায় ক্ষোভ ঝরে পড়ে।
আসলেই তো, এত লোকজনের ভিড় আর চেঁচামেচিতে পাখি থাকে নাকি? পাখি থাকে না। পাখি আসেও না। পাখির সাথে মোসলেমের কথা বলাও হয়ে ওঠে না। তাইতো পুকুরের পাড়ে কী রাখা হয়েছে তা মোসলেমের কাছ থেকে জানা যায় না। সাংবাদিকরা হতাশ হয়ে ফিরে যায় ঢাকায়। গ্রামের মানুষ কিন্তু হতাশ হয় না। বরং তারা উল্লাসে মেতে ওঠে। শহরের মানুষ পাখির বিষয়ে কী জানে? তারা মোসলেম পাগলার কথাতেই ভরসা রাখে। তারা জানে মোসলেম পাগলার ক্ষমতা। সেই ছোটবেলা থেকেই তো তারা চেনে তাকে।
পাঁচ
বগুড়া চারমাথা থেকে বগুড়া-নওগাঁ মহাসড়কে ১৭কিমি পশ্চিমে সাতপুকুর বাজার পার হয়ে হাতের ডানে চন্দ্রপুরের রাস্তা ধরে সোজা উত্তরে সাড়ে পাঁচ কিলো যাওয়ার পর ল্যাংড়াবাজারের আগেই মধুকুলকুলি জেনারেল স্টোরের মোড়ে হাতের বামে আধা কিলো গিয়ে পারহাট পাঠশালা পার হয়ে বিশাল পুকুর। এই পুকুরের পাশেই মোসলেম পাগলার ঘর। সেই ঘরের মেঝেতে পড়ে আছে মোসলেমের রক্তাক্ত লাশ। কে যেন গলা কেটে রেখেছে তার। যে বটি দিয়ে গলা কাটা হয়েছে, তা লাশের পাশেই পড়ে আছে।
পুলিশ, সাংবাদিক, আশেপাশের দশ গ্রামের মানুষ দিয়ে ভরে যায় গ্রাম। গ্রামের মানুষের সবার মুখেই হাহাকার। পাখিদের থেকে গোপন কথাগুলো আর জানা যাবে না। সবাই ফিসফিস করে কথা বলছে। শুধু একজন ছাড়া। সে হলো মজিরন বেওয়া। মোসলেম পাগলার প্রতি অনেক দরদ ছিল মজিরন বেওয়ার। গ্রামের মানুষের সবই জানা। রজব আলী মাস্টার গ্রাম ছাড়ার পর থেকে মোসলেমকে তিন বেলা ওর ঘরে গিয়ে খাবার দিয়ে আসত সে। অনেক নরম মানুষ হিসাবেই মজিরন বেওয়াকে জানে সবাই। মোসলেমকে মেরে ফেলার পর সে-ই প্রথম গিয়েছিল তার ঘরে। কাপড়ে আর শরীরে এখনও লেগে আছে রক্তের দাগ। মোসলেমের প্রতি যার এত স্নেহ সে কী কারণে হঠাৎ এমন ক্ষেপে গেল, তা অনেকেরই মাথায় ঢুকল না।
“মাস্টর গাঁও ছাড়ার পর থাক্যা কুত্তার বাচ্চাকে তিন বেলা খাওয়াইচি। হারামজাদা বিশ বচর ধর্যা হামার ওপর অত্যাচার করচে। হামার স্বামীক পানিত ঠাসা ধর্যা মারচে। অ্যাকন হামার জুয়ান মেয়েডাক জ্বলান আরম্ভ করচে।”
মজিরন বেওয়া একটু থামে। শাড়ির আঁচলে চোখের পানি মোছে। তার পর আবার শুরু করে, “অই জানোয়ার পাকি দ্যাকে না। ম্যায়া মানুষের গাও দ্যাকে। ঐ দ্যাকাই সার, কিচু করব্যারও পারে না। কাপড় খুল্যা পাচার সাথে গাও ঘষে খালি। হামার সাতে যা করচে তা মান্যা লিচি। তাই দেক্যা হামার ছলের সাতেও! শুয়োরের বাচ্চা! শুয়োরের বাচ্চা পাকির ভাষাও জানে না, খালি ভণ্ডামি।” মজিরন বেওয়ার এসব উল্টাপাল্টা কথায় কান দেয়ার সময় নেই গ্রামের মানুষের। পাগল হয়ে গেছে মেয়েমানুষটা। ‘মোসলেম পাগলা পাখির ভাষা জানে না’ এটা আর যেই হোক পারহাট গ্রামের মানুষ বিশ্বাস করে না। মিথ্যা প্রমাণ করার মানুষও নেই, সুযোগও নাই। মোসলেমের মুখ থেকে যদি শোনা যেত ‘হামি পাকির ভাষা জানি না’, তাহলেও সবাই বিশ্বাস করত কি না সন্দেহ আছে। মোসলেম পাগলা পাখির ভাষা জানে, তার অনেক প্রমাণ আছে গ্রামবাসির কাছে। প্রমাণ ছাড়া তারা কিছু বিশ্বাস করে না, ভবিষ্যতেও করবে না।
(প্রথম প্রকাশ- তর্ক বাংলা, ০১ জুলাই ২০২২)