দূরে, অনেক দূরে
হঠাৎ করেই বৃষ্টি এল।
ফিরোজ সাহেবের বৃষ্টি ভালো লাগে। তা সে হঠাৎ আসুক, চুপিসারে আসুক, আর ঢাকঢোল পিটিয়েই আসুক। তিনি এক কাপ চা নিয়ে বসার ঘরে এলেন। জানালার পর্দাটা টেনে দিলেন। ততটা ভারি বৃষ্টি না হলেও বেশ ভালো লাগছিল তার। কিন্তু বৃষ্টির শব্দকে ছাপিয়ে কলিং বেল বেজে উঠল। এক বার। দুই বার। তিন বার। বেজেই চলেছে। থামার কোনো নাম নেই।
বৃষ্টির মধ্যে কলিং বেলের শব্দকে বেশ আতংকের মনে হয় ফিরোজ সাহেবের। এ সময় যিনি আসবেন, তাকে বৃষ্টি না ছাড়া পর্যন্ত সঙ্গ দিতে হবে। আর বৃষ্টির পানিতে বাসার সামনের রাস্তা ডুবে গেলে তো কথাই নেই। অপেক্ষায় থাকতে হবে পানি না সরে যাওয়া পর্যন্ত।
কলিং বেল বেজেই চলেছে। বাসার দারোয়ান নিশ্চয় গ্যারেজের এককোণে ঘাপটি মেরে আছে। না হলে এতক্ষণে সে দরজা খুলে দিত। তার অতিথি মনে হয় বৃষ্টিতে ভিজে যাচ্ছে। এতবার কলিং বেল বাজানোর অর্থ ঐ একটাই হতে পারে। ইন্টারকমে দারোয়ানকে কল করলেন ফিরোজ সাহেব। কোনো জবাব নেই। মোবাইল ফোনে কল দিলেন । এইবার সাড়া মিলল।
‘স্যার, বলেন।’
‘গেটে কেউ একজন কলিং বেল বাজাচ্ছে বারবার । তাড়াতাড়ি খুলে দাও।’
‘জি, স্যার। এখনই দিচ্ছি।’
ফিরোজ সাহেব একটা তোয়ালে হাতে নিয়ে দাঁড়ালেন দরজায়। যেই হোক, তিনি চান না অতিথি বৃষ্টির পানিসহ সোফায় গিয়ে বসুক। তোয়ালে দিয়ে পুরো শরীর ভালোভাবে মুছতে হবে। তারপর ঘরে প্রবেশের অনুমতি পাবে। সিঁড়ি দিয়ে উঠে এসে একটা মেয়ে তাঁর সামনে দাঁড়াল। তাকে দেখেই ফিরোজ সাহেবের মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বেরিয়ে এল একটা শব্দ, ‘রাত্রি’।
শব্দটা শোনার পরই মেয়েটার চোখের কোণে এক ফোঁটা জল ভেসে ওঠে। ফিরোজ সাহেব অবশ্য পাত্তা দেননি। তাঁর কাছে এটি সাধারণ বৃষ্টির ফোঁটা থেকে আলাদা কিছু মনে হয়নি। তিনি ‘রাত্রি’কে নিয়েই ব্যস্ত আছেন। তাঁর ব্যস্ততায় ছেদ পড়ে।
‘আমি ওনার মেয়ে।’ আবেগে মাখা শব্দগুলো একদম কান্নার মতো বেজে ওঠে। ফিরোজ সাহেব এখনও ‘রাত্রি’কে নিয়ে ব্যস্ত আছেন। অনেকদিন দেখা হয়নি মেয়েটার সাথে।
‘আমার মার নাম রাত্রি।’ কাঁপা গলায় আবার বলল মেয়েটা।
ফিরোজ সাহেবের মনে হলো মেয়েটা বৃষ্টিতে ভিজে যাওয়ায় কাঁপছে। তোয়ালেটা নিজের হাতে রেখেই বললেন, ‘তুমি ভেতরে আসো। এদিকে। সোফায় গিয়ে বোসো।’
মেয়েটা না বসে একটা খাম এগিয়ে দেয় ফিরোজ সাহেবের দিকে। ফিরোজ সাহেবের কেন জানি মনে হলো জরুরী কিছু হতে পারে। খামের একপাশে ছিঁড়ে ফেলতেই একটা চিঠি বেরিয়ে এল। ফিরোজ সাহেব পড়তে শুরু করলেনঃ
“প্রিয় স্যার,
আসসালামু আলাইকুম।
স্যার, কেমন আছেন? আমি রাত্রি। ক্লাসে আর কোনো মেয়ে পড়া না শিখলেও যে মেয়েটা শিখে যেত। ক্লাসের সবাইকে আপনি প্রায়ই বলতেন, তোমরা দেখো, আমার এই মেয়েটি অনেক দূর যাবে।
সময় পেলে একটু দেখা করে যাবেন। শুধু এই কথাটা বলার জন্যই লিখছি। নয়তো পরে বলবেন, মেয়েটা চলে যাওয়ার আগে একবার দেখাও করল না। ক্লাসে তো আর কোনোদিন হাসতে দেখিনি আপনাকে। সামনে বসে সুসংবাদ দিতে চাই। যদি তাতে হাসি ফোটে আপনার মুখে। বলতে চাই, আপনার কথা সত্য হয়েছে। আমি অনেক দূরে যাচ্ছি।
আমি হয়তো আপনার কথা মতো অনেক দূরে যাবো বলেই এসএসসি পরীক্ষা যেদিন শেষ হয়, তার দুই দিনের মাথায় আমার বিয়ে হয়ে যায়। তারপর সোজা স্বামীর ঘরে। প্রথমে ভেবেছিলাম, এত আগে কেন? পরে মনে হয়েছিল, আমার যে অনেক দূরে যেতে হবে। পড়াশুনা শেষ করতে গেলে হয়তো পিছিয়ে পড়ব। বিয়ের পাঁচ বছর না যেতেই দুই সন্তান। দুইটাই মেয়ে। দুই বছর পর ছেলে নিতে গিয়ে আবারো মেয়ে। বিয়ের দশ বছরের মাথায় পৃথিবীর সবাইকে খুশি করে ছেলে সন্তান উপহার দিলাম। একটা নয়, এক জোড়া। যমজ। আমার এই পাঁচ সন্তান আমাকে অনেক দূরে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করে দিয়েছে।
বত্রিশ বছর বয়সে যখন আমার জরায়ু-মুখ ক্যান্সার ধরা পড়ে, ডাক্তার বলেছিল, ‘ডাক্তারের কাছে বয়স লুকাবেন না। ঠিক বয়স বলুন। এই বয়সে এই রোগ হওয়ার কথা নয়।’ আমি কিছুই বলিনি তখন। মনে মনে ভেবেছিলাম, এই বয়সে তো আমার অনেক কিছুই হওয়ার কথা ছিল না। পাঁচ বাচ্চা তো একদম নয়। বাসায় ফিরে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজেকে একটু ভালো করে দেখলাম। যে অবস্থা দেখলাম, তাতে আমাকে চল্লিশের বেশি বয়সী মনে হলো। আপনি আবার আমাকে দেখে যেন আমার মা ভেবে ভুল করবেন না। আমার মা অনেক আগেই মারা গিয়েছেন।
আশা করি খুব দ্রুত আসবেন। আপনার কথামতো অনেক দূরে যাওয়ার আগেই আপনার মেয়েটাকে একবার দেখে যাবেন।
স্যার, আমার বড় মেয়েটাকে আপনার কাছে পাঠালাম। খুব বেশি বড় দোয়া করার প্রয়োজন নেই। ওর জন্য ছোটোখাটো একটা দোয়া করে করে দিয়েন। আপনার দোয়া আবার সত্যি হয়।
আপনার অপেক্ষায় রইলাম।
‘অনেক দূরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত আপনার এক মেয়ে’ ”
চিঠি শেষ করে ভেজা চোখে মেয়েটার দিকে তাকালাম। রাত্রির সাথে অনেক মিল। বললাম, ‘তুমি একটু বোসো, পাঁচ মিনিট, আমি ড্রেসটা পাল্টে আসি। তোমার সাথে যাবো আমি। রাত্রিকে দেখতে।’
‘মা তো নেই।’
‘নেই মানে?’
‘গত মাসে মারা গিয়েছে। মারা যাওয়ার আগে চিঠিটা আমার কাছে দিয়েছিল। বলেছিল, আপনার কাছে পৌঁছাতে হবে। বিভিন্ন ব্যস্ততায় আসা হয়নি।’
এতটুকু বলেই সে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
মেয়েটা দাঁড়িয়ে থেকে অঝোর ধারায় কাঁদছে। একবার ভাবলাম, বসতে বলি অথবা, মাথায় হাত বুলিয়ে দিই। কিছুই করলাম না। কাঁদতে থাক। কেঁদে কেঁদে শক্ত হোক। যে পৃথিবী ওর জন্য অপেক্ষা করছে, সেটি রাত্রির পৃথিবীর চেয়েও কঠিন হবে।
(প্রথম প্রকাশ- দৈনিক সময়ের আলো, ১৩ জানুয়ারি ২০২৩)