ছিনতাই
জীবনের অনেককাল ছিনতাই এর হাত থেকে বেঁচে আছেন মজিদ সাহেব। কিন্তু আজ আর রক্ষা নেই। ব্যাংকে ঢোকার পর থেকেই একটা অস্বস্তি কাজ করছে তার মনে। কেন জানি মনে হচ্ছে, বেতনের টাকা আজ বাড়ি পর্যন্ত পৌঁছবে না। বত্রিশ হাজার টাকার একটা চেক হাতে নিয়ে তিনি লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন। চেকটা কায়দা করে ভাঁজ করে রেখেছেন যাতে কেউ সহজে টাকার অঙ্কটা দেখতে না পারে। আর তিনজন পরেই ডাক পড়বে মজিদ সাহেবের।
ক্যাশের সামনে দাঁড়ানো লুঙ্গি পরা লোকটা পাঁচশ টাকার বান্ডিলগুলো বাজারের ব্যাগে ভরছে। এই লোকটাকে দেখলে কেউই বিশ্বাস করবে না যে তার কাছে এত টাকা আছে। কাউন্টার থেকে একটু দূরে একটা ছেলে মোবাইলে ফিসফিস করে কথা বলছে। ব্যাংকের ভিতরে মোবাইল ফোনে কথা বলা নিষেধ। কে শোনে কার কথা! মজিদ সাহেবের মনে হলো ছেলেটা গেটের বাইরে থাকা কাউকে বলে দিচ্ছে, “লুঙ্গি পরা এক লোক কিছুক্ষণ পর ব্যাংক থেকে বের হবে। বাজারের ব্যাগে মাল আছে।” লোকটার জন্য তার দুঃখ হচ্ছে।
মজিদ সাহেবের পালা এল। কাউন্টারে দাঁড়িয়ে চেকটা এগিয়ে দিলেন। কাউন্টারে বসা সুদর্শন ছেলেটা তাচ্ছিল্যভরে টাকার পরিমাণটা দেখল। মজিদ সাহেব টাকাগুলো নিয়ে খুব ভালো করে পরীক্ষা করে নিলেন। ঠিক আছে। ছেঁড়া বা নকল নোট নেই। কিন্তু ছেলেটা তো এখনও কথা বলছে। আশ্চর্য। কেউ প্রতিবাদ করছে না। তার মনে হলো, এবার তার কথাই বাইরে বলে দিচ্ছে, “ফতুয়া পরা। চুল মেহেদি করা। টাকা প্যান্টের ডান পকেটে।”
মজিদ সাহেব ছেলেটাকে আবার দেখলেন। তার কাছে ব্যাপারটা ভাল ঠেকছে না। গেটের কাছে গিয়েও আবার ফিরে আসলেন। ব্যাংকের ভিতরে সোফায় বসে পড়লেন। ছেলেটা আগে চলে যাক। তার পর তিনি বের হবেন। প্রায় আধা ঘণ্টা পর সে চলে গেল। মজিদ সাহেব টাকা ডান পকেট থেকে বাম পকেটে নিলেন। তারপর আরও মিনিট দশেক অপেক্ষা করে বাইরে এলেন।
মজিদ সাহেব হাঁটছেন। ঘেমে গিয়েছেন। ছিনতাই এর চিন্তা এখনও ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। প্যান্টের পকেটে রাখা বড় মেয়ের থেকে গিফট পাওয়া বারো হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোনটা আজ ছিনতাইকারীরা নিয়ে যাবে। সাথে যাবে বেতনের বত্রিশ হাজার টাকা। ভয়টা ভালই কাজ করছে তার ভিতরে। মোবাইল না হয় নিয়ে গেল, সমস্যা হবে না। কিন্তু বেতনের টাকা নিলে তিনি চলবেন কীভাবে? বাড়ি ভাড়া। মাসের বাজার খরচ। ছোট মেয়ের স্কুলের বেতন। সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেললেন, প্রাণ গেলেও টাকা হাতছাড়া করবেন না। নিজেকে সান্ত্বনা দিলেন, ‘দূর এত ভয় কিসের? রাস্তায় কত লোকজন!’ কিন্তু সমস্যা হলো, লোকজনের ভিড়ের মাঝেও প্রতিদিন ছিনতাই চলছে। কারো ছিনতাই হলে কেউ এগিয়ে আসে না।
সামনের মোড়ে কয়েকটা ছেলে দাঁড়ানো। নিজের অজান্তেই থমকে দাঁড়ালেন মজিদ সাহেব। ছেলেগুলো ছিনতাইকারী নয়ত? ওদের চেহারা কেমন যেন অস্বাভাবিক লাগছে। কাছে গেলেই হয়ত ডেকে বসবে, “এইযে চাচা। একটু দাঁড়ান।” দাঁড়ালেই শেষ। বলবে, “কাছে যা আছে চুপচাপ দিয়ে দেন। না হলে পরপারে পাঠিয়ে দেবো।” বেশি জোরাজুরি করলে বা বাধা দিলে এরা চাকু বসিয়ে দেয় শরীরে। এদের দয়ামায়া বলতে কিচ্ছু নাই। মজিদ সাহেব জোর কদমে হাঁটা শুরু করলেন। ওদের একদম কাছে চলে এসেছেন। হাঁটার গতি কিছুটা কমে গেছে তার। ধীরে ধীরে পার হয়ে গেলেন ওদের। যাক বাঁচা গেল!
খুব তৃষ্ণা পেয়েছে মজিদ সাহেবের। কিন্তু পানি খেয়ে দাম দেবেন কীভাবে? এতগুলো টাকা আছে মানিব্যাগে। কেউ যদি দেখে ফেলে! ছিনতাইকারীরা সব বিশাল গ্রুপে থাকে। আর সবখানেই তাদের লোকজন আছে। দোকানগুলোর সামনে তো ওদের লোক থাকবেই। মানিব্যাগ ভর্তি টাকা দেখলেই সংবাদ চলে যাবে। তারপর সুযোগ বুঝে তাকে ঘিরে দাঁড়াবে কয়েকজন। দরকার নেই পানির। কষ্ট করে বাসায় গিয়েই তার পর খাবে।
আর হাঁটতে মন চাচ্ছে না। রিক্সা নিলেন। অনেক দর কষাকষির পর একজন পনের টাকায় যেতে রাজী হলো। রিক্সায় উঠেও মজিদ সাহেব ঘামছেন। তার মন থেকে এখনও ছিনতাই-ভীতি যায়নি। ইদানিং অনেক ছিনতাইকারী মোটর সাইকেলে ঘোরে। হঠাৎ করে রিক্সার সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সবকিছু নিয়ে যায়। কিছুদূর যাওয়ার পর মজিদ সাহেব সিদ্ধান্ত নিলেন বাকি রাস্তা বাসে যাবেন। রিক্সাওয়ালাকে দাঁড়াতে বললেন। মানিব্যাগটা আড়াল করে রেখে বিশ টাকার একটা নোট বের করে দিলেন। “পাঁচ টাকা ফেরত দাও।”
“ভাংতি নাই।”
মজিদ সাহেব মনে মনে বললেন, “তোমাদের কাছে কখনই খুচরা থাকেনা। চোর-বাটপাড়ে দেশটা ভরে গেল। মানুষ এত মিথ্যা বললে কীভাবে চলে?”
রিক্সাওয়ালার মুখের দিকে তাকালেন। সহজসরল ভঙ্গি। ভাবলেন, ‘এই মুখেও যদি মিথ্যা বের হয় তাহলে আর করার কিছু নাই।’ কোনো কথা না বলে বাসে গিয়ে বসলেন। জানালার পাশের সিট। এই আর এক বিপদ। বাস ছাড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে জানালা দিয়ে হাত দিয়ে ছিনতাইকারীরা ঘড়ি, মোবাইল, গলার চেইন টান দিয়ে নিয়ে যায়। মেয়েদের কানের লতি ছিঁড়ে তাদের কানের দুল নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। মজিদ সাহেব তার মোবাইলটা হাতে শক্ত করে ধরে জানালা ছয় ইঞ্চির মত খোলা রাখলেন।
বাস ছেড়ে দিয়েছে। বাসা ভাড়া আর মেয়ের স্কুলের বেতন আজকেই দিতে হবে। একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেলেন মজিদ সাহেব। আচমকা তার জানালা দিয়ে একটা হাত ভেতরে এল। পাশে বসা লোকটা ছিনতাইকারী বলে চিৎকার করে উঠল। মজিদ সাহেব কি করবেন ভেবে পেলেন না। তিনি জানালাটা আটকে দিলেন। হাতটা আটকা পড়ল জানালায়। গাড়ির গতি কিছুটা বেড়েছে। গতি আর একটু বাড়তেই তার সম্বিৎ ফিরে এল, ‘লোকটা যদি চাপা পড়ে!’ তিনি জানালা খুলে দিলেন। পাশ থেকে একজন চিৎকার করে উঠল, “আরে ভাই, কী করেন! হাতে পেয়েও ছেড়ে দেবেন নাকি ব্যাটাকে?”
গাড়ির চাকার নিচে একটা শব্দ হলো। কে যেন চিৎকার করে উঠল, “মরেছে! ছিনতাইকারী মরেছে!”
অন্য কোনভাবে দুর্ঘটনা ঘটলে ড্রাইভার পালিয়ে যেত। এখানে তা হলো না। ড্রাইভারসহ সবাই বীরদর্পে নেমে পড়ল ছিনতাইকারীকে দেখতে।
মজিদ সাহেবের শরীরের কাঁপুনি থামেনি তখনও। নিচে নেমে গেলেন তিনিও। লোকজন ঘিরে আছে লাশটাকে। একজন বলে উঠল, “একদম ভর্তা হয়ে গেছে। উচিত শিক্ষা হয়েছে। কত লোকের যে সর্বনাশ করেছে। এখন কেমন লাগে বাছাধন?”
আরেকজন বলল, “হাতের মুঠোটা খুলে দেখেন তো কোন চেইন-টেইন আছে নাকি?”
একজন বীরদর্পে এগিয়ে গেল। মুঠো খুলতেই বেরিয়ে এল পাঁচ টাকার এক নোট। “শালা আজ পাঁচ টাকা নিতে গিয়ে মরেছে । চোরের দশদিন আর সাধুর একদিন।”
মজিদ সাহেব ভিড় ঠেলে সামনে গেলেন। ছিনতাইকারীর মুখ দেখেই আঁতকে উঠলেন। এ যে সেই রিকশাওয়ালা, যার রিক্সা থেকে নেমে বাসে উঠেছেন। সেই সহজসরল ভঙ্গি। পাঁচ টাকা হাতে ধরা। তাকে ফেরত দিতে এসেছিল নিশ্চয়।
মজিদ সাহেবের দুচোখ ভিজে আসে। তিনি একদৃষ্টিতে চেয়ে আছেন পাঁচ টাকার নোটের দিকে। নোটটি বাতাসে নড়ছে আর ছিনতাই হয়ে যাওয়া তার সমস্ত বিশ্বাসকে নাড়া দিয়ে যাচ্ছে।
(প্রথম প্রকাশ- গল্পকার, এপ্রিল ২০২২)