ছায়ামানব
“তোমাকে দেখিনি
এক মাস চব্বিশ দিন!
বিছানায় শুয়ে, বসে,
হাহাকার শুনি শৃঙ্খলিত হৃদয়ের।”
ছায়ামানব পাঠিয়েছে মেসেজটা। আজ বিকেলবেলা। তারপর থেকে এই রাত অবধি মেসেজটা যে কতবার দেখেছে হৃদিতা তা হিসাব করে মেলানো মুশকিল। প্রতি দশ মিনিটে এক বার হতে পারে। আবার প্রতি দশ মিনিটে দশ বারও হতে পারে। তার বেশিও হতে পারে। এসব হিসাব করে কোনও লাভ নেই। মেসেজটা পড়তে ভালো লাগছে এটাই সবচেয়ে বড় কথা।
ছায়ামানবের সাথে হৃদিতার যোগাযোগ প্রায় এক বছরের। তিনশ পনেরো মিউচ্যুয়াল ফ্রেন্ড এর আইডি থেকে যখন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট আসে, তখন তা অগ্রাহ্য করা কঠিন হয়ে পড়ে। ছায়ামানবের ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। ছায়ামানবের প্রোফাইল পিকচার নামের সাথে মিল রেখে কোনও এক থ্রিলার থেকে নেওয়া। ফরটিন কে ফলোয়ারস। টাইমলাইনে কবিতা আর কোটেশানের ছড়াছড়ি। প্রতিটা পোস্টে হিউজ রেসপন্স। নিজের অজান্তেই কনফার্ম বাটনে আঙুল চলে যায় হৃদিতার। তার পর থেকেই শুরু হয় জীবনকে ভালোলাগার অন্য এক আবেশ।
গত এক বছর ধরে ছায়ামানব সত্যিকার অর্থেই ছায়ার মতো লেগে আছে হৃদিতার সাথে। ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট অ্যাকসেপ্ট করার পরদিন সকালে বাসা থেকে গাড়ি করে ভার্সিটির উদ্দেশে রওনা হওয়ার মিনিট দশেক পরেই ছায়ামানবের প্রথম মেসেজটা পায় সে। মেসেজ বলতে কয়েক লাইনের কবিতা।
আকাশের নীলে
কেন মেখেছ
তোমায় তুমি?
সূর্যের আভা
যেন দিয়েছে
তোমায় চুমি।
হৃদিতার চোখে বিস্ময়। কিছুটা সহজ সমীকরণ দাঁড় করায় সে। বাসা থেকে বের হওয়ার পরপরই মেসেজ পাওয়ার অর্থ হলো, ছায়ামানব তার বাসার আশেপাশেই থাকে। যেখান থেকে তাদের গ্যারেজ পর্যন্ত দেখা যায়। গাড়িতে ওঠার আগেই তো তাকে দেখতে হবে। আর তা না হলে তার পোশাকের রং বুঝবে কী করে! তাদের সামনের ফ্ল্যাটের কেউ হতে পারে। তবে এই যুক্তি সে সাথে সাথেই নাকচ করে দেয়। কারণ কারও পক্ষে সারাক্ষণ দরজায় চোখ লাগিয়ে রাখা সম্ভব নয়। সে তো আর প্রতিদিন একই সময় বাসা থেকে বের হয় না।
ছায়ামানবকে নিয়ে একরকম গোলকধাঁধাতেই পড়ে হৃদিতা। পরে মনে হয় কী দরকার এরকম হন্যে হয়ে খোঁজার! হৃদিতা ছায়ামানবের মেসেজের উত্তর পাঠায়, ‘ধন্যবাদ’। সেই থেকেই সম্পর্কের শুরু। সম্পর্ক বলতে মেসেজ আদানপ্রদানকে যদি কোনো সম্পর্কের কাতারে ফেলা যায় তবে তাই। হৃদিতা অবশ্য কয়েকবার মোবাইল নম্বর চেয়েছে ছায়ামানবের কাছে। মেসেঞ্জারে কল দিয়েছে। পরিচয় জানতে চেয়েছে। সবকিছুতেই ফলাফল শূন্য। ছায়ামানবের একটাই উত্তর, ‘আমি ছায়ামানব। ছায়া হয়েই থাকতে চাই।’
হৃদিতার মাস্টার্স পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর সিলেট বেড়াতে এসেছে বড় খালার বাড়িতে। আজ দিয়ে এক মাস চব্বিশ দিন। তার এত সূক্ষ্ম হিসাব ছিল না। ছায়ামানবের মেসেজ পাওয়ার পর থেকেই সেটা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ করেই কেন জানি তার মনে হচ্ছে, অনেক বেশি সময় থাকা হয়েছে এখানে। তাছাড়া সিলেটের আশেপাশের সব জেলা ঘুরে বেড়ানো শেষ। এখন অবশ্যই ঢাকা ফেরা যায়। রাতে খাবার বসে খালাকে বিষয়টা জানায় সে। প্রথমে তিনি একটু আপত্তি করলেও পরে হার মানেন তিনি। হৃদিতা পরদিন সকালের প্রথম ফ্লাইটেই ঢাকা ফিরে আসে। সকাল এগারোটায় বাসায় ঢুকে লাল রঙের পোশাকটা পাল্টে নিয়ে একটু ফ্রেশ হতেই ছায়ামানবের মেসেজটা পায় সে। এই মেসেজের জন্যই অপেক্ষা ছিল তার।
ভোরের লাল সূর্যের সাজ,
রেখেছে এই অবধি আজ।
হৃদয় জুড়ে রক্তের কাজ,
দেখেছে এই মনের লাজ।
হৃদিতা নিজেই অবাক হয়ে যায়। একজন মানুষকে সে কখনও দেখেনি, তার পরিচয় জানে না, তার সাথে কথা হয়নি, কিন্তু তারপরও তার জন্য প্রাণের কত আকুতি! এই আকুতি আরও বেড়ে যায় মাসখানেক পরে, যখন হৃদিতার বিয়ের দিনতারিখ ঠিক হয়ে যায়। হৃদিতার মনে হয়, সে পাগল হয়ে যাবে। যে মানুষ তাকে এত ভালোবাসে, সারাক্ষণ ছায়ার মতো অনুসরণ করে, সে তার জীবনসঙ্গী হবে না, এটা সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারে না। কিন্তু মানুষটা যদি সামনেই না আসে তাহলে তো আর করার কিছু থাকে না। হৃদিতার বিয়ে হয়ে যায়। বিয়ের পরের দিন একটা মেসেজ আসে ছায়ামানবের আইডি থেকে।
প্রিয় হৃদিতা,
আমি একা,
অথবা, আমাতে তুমি
মিলে, আমরা একা।
যেভাবেই আমার হিসাব যাক,
পথ শেষেই মিলবে,
আমার – আমাদের একার, একাকী সূর্যের দেখা।
আমার জীবনের হিসাবটাই এমন। এখানে আমি একা। আমি তোমার সাথে মিশে গেলেও হিসাবটা আগের মতোই থাকবে। আমাদের একাকীত্বে কোনো পরিবর্তন আসবে না। কারণ তুমি সূর্য। তোমার মাঝে যেদিন আমি বিলীন হয়ে যাব, সেদিন আমার সবকিছুকে ধারণ করেও তুমি একাই থাকবে। তাই সিদ্ধান্ত নিয়েছি,
ভালোবেসে যাব চিরদিন,
মিলনে কভু হবনা বিলীন।
ইতি-
ছায়ামানব
এটাই ছিল ছায়ামানবের শেষ মেসেজ। কারণ তার পর থেকেই হৃদিতা যতবার ফ্রেন্ডলিস্টে গিয়ে ছায়ামানবকে খুঁজেছে ততবারই দেখেছে ‘অ্যাকাউন্ট ডি-অ্যাকটিভেটেড’।
বিয়ের সপ্তাহখানেক পরে কৌতূহলবশত হৃদিতা তার মাকে জিজ্ঞেস করে, ‘আমাদের সামনের ফ্ল্যাটের ভাড়াটিয়া কি এখনও আছে?’
মা বলে, ‘হ্যাঁ, ওরা এখনও আছে। তবে তোর বিয়ের পরদিনই আমাদের বিশ্বস্ত দারোয়ান ছেলেটা কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। ওর মোবাইল নম্বরও বন্ধ। কোথায় যে গেল ছেলেটা? অনেক ভালো ছিল সে।’
হৃদিতার মনে পড়ে ছায়ামানবের কথা। আশ্চর্য মানুষের মন! দারোয়ানের হারিয়ে যাওয়ার সাথে ছায়ামানবের কী সম্পর্ক!
বছর তিনেক পরের কথা। হৃদিতা সহকারী প্রভাষক হিসেবে সরকারি একটা কলেজে যোগ দিয়েছে। ইংরেজি বিভাগ। বিভাগীয় প্রধানসহ অন্যান্য সকল শিক্ষক একটা বড় কক্ষে বসেন।
শিক্ষকদের চা-নাস্তা দেওয়া থেকে শুরু করে যাবতীয় কাজের দায়িত্বে আছে দুজন। এর মাঝে একজন মুনিবুর। কিছুদিন আগে জয়েন করেছে। স্মার্ট একটা ছেলে। হৃদিতার জন্য সে সবসময় হাজির। সকালে যখন কলেজে আসে তখন ‘ইংরেজি বিভাগ’ লেখা গেটের পাশে দাঁড়িয়ে তাকে সালাম দেবে। আবার তার বিদায়ের সময়ও একইভাবে হাজির থাকবে। মাঝের সময়টায় সে কখন চা খাবে, কখন কফি খাবে, কখন শুধু পানি খাবে, সবকিছুই মুনিবুরের মুখস্থ। শুধু ইশারা করলেই হয়। হৃদিতা লক্ষ করে দেখেছে অন্য শিক্ষকদের বেলায় এমনটা করে না মুনিবুর। তার জন্য একটু স্পেশাল ট্রিটমেন্ট।
হৃদিতার মনে পড়ে ছায়ামানবের কথা। ওদের বাসা থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া দারোয়ানের কথা। অনেক চেষ্টা করে তার চেহারার সাথে মুনিবুরকে মেলানোর জন্য। পারে না। কীভাবে পারবে? বাসার দারোয়ানকে সে কখনও ভালোভাবে খেয়ালই করেনি।
আশ্চর্য মানুষের মন! এর সাথে ছায়ামানবের কী সম্পর্ক! হৃদিতা ‘ডি-অ্যাকটিভেটেড’ আইডি ছায়ামানবের কথা মনে করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। নাহ! ছায়ামানব কিছুতেই তার পিছু ছাড়ছে না। ছায়ার মতোই লেগে আছে তার সাথে।
তার এই সাথে থাকার কথা ভাবতেই ভালো লাগে হৃদিতার। অন্যরকম একটা আবেশে মন ভরে যায়। একটা প্রশান্তির ছোঁয়া লাগে হৃদয়ে। কেউ একজন ভাবছে তাকে নিয়ে। সারাক্ষণ। ছায়ামানব ছায়া হয়েই থাকুক আজীবন।
(২০ জুন, ২০২২)