এক হাজার টাকার গল্প-শিকারী
১
প্রতিদিন সকালবেলা হাঁটতে বের হয়ে গল্প শিকার করাটা ইদানীং একদম নেশার পর্যায়ে দাঁড়িয়ে গেছে আমার। খুব বেশি কিছু করতে হয় না আমাকে। সকাল ছয়টা থেকে সাতটা, এই এক ঘণ্টার হাঁটাহাঁটির মাঝে যে-কোনো একজন মানুষকে বেছে নিয়ে তার হাতে তুলে দেই এক হাজার টাকার একটা চকচকে নোট। খুবই স্মল ইনভেস্টমেন্ট। কিন্তু আউটপুট অনেক ভালো। যাকে টার্গেট করে টাকাটা দেই মূলত তার কাছ থেকেই মেলে আমার গল্পের প্লট। কোনো সময় শুধু তার মুখের অভিব্যক্তি থেকেই পেয়ে যাই এই প্লট। আবার কোনো সময় আমার সাথে শেয়ার করা তার জীবনের গল্প থেকে মেলে আমার কাঙ্ক্ষিত কাহিনি।
প্রতিদিনের মতো সেদিনও হাঁটছিলাম হাতিরঝিলে। হঠাৎ করেই চোখ পড়ল এক বৃদ্ধের ওপর। ওয়াকওয়ের পাশে বসে ভিক্ষা করছেন। ধবধবে সাদা চুল, দাঁড়ি, গোঁফ। সাদা পাঞ্জাবি, পায়জামা। সবকিছুতেই একটা শুভ্রতার ছোঁয়া। সাধারণ ভিক্ষুকের মতো চেহারায় মলিনতার কোনো ছোঁয়া নেই। সারা অবয়ব জুড়ে যেন একটা নিষ্পাপ মানুষের প্রতিচ্ছবি ভাসছে।
আমি লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়াই। তার পর জিজ্ঞাসা করি, ‘সারাদিনে কত টাকার ভিক্ষা পান?’
লোকটা চোখ তুলে তাকায় আমার দিকে। স্বচ্ছ চোখজোড়া, যেখানে বিন্দুমাত্র ক্লান্তি নেই, নেই লুকানোর মতো কোনোকিছু, কোনো পাপ নেই। উনি বলেন, ‘ ঠিক নাই, বাজান। পাঁচশ, এক হাজার, কোনোদিন হয়তো তার চেয়েও বেশি।’
মাত্র কয়েকটা শব্দ। শব্দগুলো যখন তার মুখ থেকে বের হয়ে ছড়িয়ে পড়ে, তখন আমি আরও মুগ্ধ হয়ে যাই। ভরাট গলা। এই কণ্ঠে ভিক্ষা-চাওয়া মানায় না, এই কণ্ঠ কবিতার, এ কণ্ঠ প্রেমের, এ কণ্ঠ মানুষকে কাছে টানার, এ কণ্ঠ মানুষকে ভালোবাসার বাঁধনে শৃঙ্খলিত করার। আমি নিশ্চিত এ কণ্ঠ যে একবার শুনবে সে থমকে যাবে, থমকে যাবে তার পৃথিবী। আমার ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হয় না। পাগুলো আটকে যায় সেখানে। মনে হয় বসে পড়ি তার পাশে। গল্প শুনি এক হাজার এক রাতের। মনটা আনন্দে ভরে ওঠে। গল্প শিকারের নেশায় পকেট থেকে বের করি এক হাজার টাকার এক নোট। ‘এই নেন, এক হাজার টাকা। বাসায় চলে যান। আজ আর ভিক্ষা করার দরকার নেই আপনার।’
টাকাটা হাতে পেয়েই লোকটার চেহারা পাল্টে যায় এক নিমিষেই। চোখের স্বচ্ছতায় জমা হয় লাল ছোপ ছোপ রক্ত। আমার মনে হয় টাকাটা ভুল জায়গায় চলে গিয়েছে। আমি আরও একবার তাকাই তার মুখের দিকে। নিষ্পাপ সেই অভিব্যক্তি হারিয়ে গেছে। এক হাজার টাকা নীট লস ধরে নিয়েই হাঁটতে শুরু করি আবার। কয়েক পা যেতেই পেছন থেকে ডাক আসে, ‘দাঁড়ান বাজান।’
কণ্ঠে আগের সেই সম্মোহনী শক্তি না থাকলেও আমি থেমে যাই। বৃদ্ধ লোকটা ততক্ষণে উঠে এসেছেন আমার পাশে। আচমকা আমার হাতে ধরে বলেন, ‘অনেক সাধনার পর আপনাকে পেয়েছি, বাজান। আমার কোম্পানিতে আপনাকে জয়েন করতে হবে।’
আমি অবাক। সিনেমা নাকি! বৃদ্ধের দিকে তাকিয়ে বলে উঠি, ‘কিন্তু আমি তো জব করি।’
উনি নাছোড়বান্দা। আমার হাত আরও শক্ত করে ধরে বলেন, ‘তাহলে আমার বাসায় গিয়ে এক কাপ চা খেয়ে আসতে হবে। একটু সামনে আমার গাড়ি পার্ক করা আছে।’
আমি বেশিকিছু ভাবার সময় পেলাম না। ভাবার কোনো সুযোগও ছিল না। মনে হচ্ছিল, আমি কোনো নাটক বা সিনেমায় অভিনয় করছি। পরের দৃশ্যে আমাকে গাড়িতে গিয়ে বসতে হবে। পরিচালকের ডিরেকশান অনুযায়ী। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমি গাড়িতে উঠে বসলাম। বেশ দামি গাড়ি। আমার তখনও সিনেমার কাহিনি মনে হচ্ছিল। চুপ থাকতে না পেরে বলেই ফেললাম, ‘চাচা, আমার কাছে মনে হচ্ছে, আমি কোনো সিনেমা দেখছি।’
‘সিনেমাই বাজান। তবে আরও কিছু বাকি আছে। এখন তোমার মানিব্যাগ, মোবাইল আর ঘড়িটা আমাকে দিয়ে দাও।’ বৃদ্ধের গলার স্বরে আমূল পরিবর্তন। এখানে আর কবিতার কোনো অবকাশ নেই।
আমার কোমরের পাশে একটা পিস্তল ধরা। বৃদ্ধের চাহিদামত সব দিয়ে দিলাম। উনি আমার মানিব্যাগ থেকে একটা এটিএম কার্ড বের করলেন। বললেন, ‘আমরা সামনে একটা এটিএম বুথে দাঁড়াব। সেখান থেকে আমাকে বিশ হাজার টাকা ক্যাশ তুলে দিলেই মোবাইল আর কার্ডসহ মানিব্যাগ ফেরত পাবে। অন্যদিকে দৌড় দিলে বা বুথের গার্ডকে জানালে আমি তোমার এগুলো নিয়ে গাড়ি একটান দিয়ে চলে যাব।’
কয়েকটা ডেবিট ও ক্রেডিট কার্ড, ন্যাশনাল আইডি কার্ড, বিভিন্ন শপের মেম্বারশিপ কার্ড, সাথে আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ ভিজিটিং কার্ড হারাতে মন চাইলো না আমার বলেই আমি তার কথামতো কাজ করলাম। গাড়িটা চলে যাওয়ার সময় নম্বর প্লেটের দিকে তাকালাম। কোনো নম্বর প্লেট নেই গাড়িতে। আর হাঁটতে মন চাইল না। একটা রিকশা নিয়ে আমার নিউ ইস্কাটন রোডের বাসার দিকে রওনা দিলাম। রিকশায় বসে মনে মনে বললাম, ‘গল্পের প্লট একটা পাওয়া গেল, তবে কস্টিংটা একটু বেশিই পড়ে গেল!’
২
হাতিরঝিলে হাঁটার সময় গল্পের প্লট খোঁজার পাশাপাশি বৃদ্ধ লোকটাকে প্রায়ই খুঁজে ফিরি আমি। নিশ্চয়ই এটা তার পেশা। এভাবেই মানুষকে ঠকায় সে। প্রতিদিন কোথাও না কোথাও বসে সে নতুন শিকারের নেশায়। কিন্তু তার দেখা মেলে না।
প্রায় মাসখানেক পর একদিন বৃদ্ধ লোকটার দেখে মেলে। একই জায়গায়। ভাবলাম, ‘আগে কিছু মানুষ জড়ো করতে হবে । কারণ তার কাছে তো অস্ত্র থাকে। একা একা তাকে সামাল দেওয়া মুশকিল হয়ে যাবে।’ কিন্তু তার আগে আমি একদম নিশ্চিত হতে চাইলাম এই বৃদ্ধই আগের বৃদ্ধ কি না। তাই আমি বৃদ্ধের হাতে এক হাজার টাকার একটা নোট তুলে দিলাম।
বৃদ্ধ তার পকেট থেকে কয়েকটা লাল ট্যাবলেটসহ ছোট একটা পলিথিনের প্যাকেট বের করে আমার হাতে দিলো। বলল, ‘তাড়াতাড়ি কেটে পড়। যে-কোনো সময় পুলিশ চলে আসতে পারে।’
আমার মনে হলো, আমি নিজেই পুলিশ ডেকে আনি। কিন্তু পরে ভাবলাম, তাতে আমার ঝামেলা আরও বাড়তে পারে। বৃদ্ধ লোকটার যা বুদ্ধি! আমাকে যে-কোনোভাবে ফাঁসিয়ে দিতে পারে।
আমি পলিথিন প্যাকেটের দিকে তাকালাম। ইয়াবা নাকি? নাকি ইয়াবার মতো রং করা সাধারণ ট্যাবলেট? বৃদ্ধের ধাপ্পাবাজির আরেক কৌশল। হয়তো আমাকে চিনে ফেলেছে সে। যারা দ্বিতীয়বারের মতো তার শিকারে পড়ে, তাদের ক্ষেত্রে সে হয়তো এই টেকনিক অবলম্বন করে। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে পলিথিন প্যাকেটটা ঝিলের পানিতে ছুঁড়ে মেরে রিকশা করে বাসার পথ ধরলাম। গল্পের প্লট মিললেও একটা অতৃপ্তি থেকে গেল মনে।
৩
আরেকদিনের ঘটনা। সেদিন হাতিরঝিলে এক ঘণ্টা হাঁটার পর বোনাস হিসেবে আরও পনেরো মিনিট হাঁটলাম। কিন্তু এক হাজার টাকা দেওয়ার মতো কাউকে খুঁজে পেলাম না। শেষে একটা রিকশা নিয়ে বাসার পথ ধরলাম। এই রিকশা ওঠা নিয়ে আবার আমার কিছু নিয়ম আছে। আমার সামনে যদি কয়েকটা রিকশা থাকে, তাহলে আমি সবচেয়ে বয়স্ক আর দুর্বল মানুষটাকে বেছে নিই। ভাড়া ঠিক করিনা কখনও। তাদের যা প্রাপ্য তার দ্বিগুণ বা তারও বেশি দিয়ে নেমে পড়ি রিকশা থেকে। কারণ আদিমকাল থেকে চলে আসা মানুষের টানা গাড়ির কিছুটা বিবর্তন ঘটিয়ে এখনকার রিকশা যারা চালু রেখেছে, তাদের প্রতি আমাদের সীমাহীন কৃতজ্ঞতাবোধ থাকা উচিত বলে আমি মনে করি।
রিকশায় উঠেই আমি এসব বয়স্ক মানুষদের সাথে কথা বলি। বাড়ি কোথায়? ঢাকায় কোথায় থাকেন? কত দিন পরপর বাড়ি যান? ইত্যাদি । কিন্তু কখনই জিজ্ঞাসা করি না, ‘এই বয়সে রিকশা চালান কেন?’ কারণ, এমনিতেই পঁচাত্তর কেজি ওজনের একজন মানুষ আরামে বসে থেকে তাকে শারীরিকভাবে কষ্ট দেই। তার পর আবার এই জাতীয় সেন্সিটিভ প্রশ্ন করে তার মনে কষ্ট দেওয়ার কোনো মানে হয় না। কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর একটা রিকশা নজরে এল। বয়স্ক একজন মানুষ রিকশার হাতল ধরে বিষণ্ণ মনে দাঁড়িয়ে আছে। বয়স্ক না বলে বৃদ্ধ বলাই শ্রেয় হবে।
আমি রিকশায় বসলাম। কোথায় যাব শুনে তিনি রিকশা টানতে শুরু করলেন। তাঁর সাথে আলাপচারিতা করতে গিয়েও থেমে গেলাম। কারণ উনি প্রচণ্ড হাঁপাচ্ছিলেন। রিকশা চালানো আর কথা বলা এই দুই কাজ একসাথে করা তার পক্ষে কোনোভাবেই সম্ভব নয়। ধবধবে সাদা চুলের মাথা থেকে ঘাম অনবরত গড়িয়ে পড়ছিল ঘাড় বেয়ে। শার্টের বড় বড় ছেঁড়া দিয়ে তাঁর পিঠের যে অংশ দেখা যাচ্ছিল, সেখানেও অনবরত ঘাম ঝরছিল। মাঝে একবার মনে হলো ওনাকে বলি, ‘আমি না হয় অন্য রিকশায় যাই চাচা?’
কিন্তু বললাম না। যে লোকটা এই বৃদ্ধ বয়সে রিকশা চালানোর সাহস করেছেন, তাঁর রিকশা থেকে মাঝপথে নেমে গিয়ে তাকে ছোটো করার সাহস পেলাম না।
আমার বাসার সামনে পৌঁছানোর পর রিকশা থেকে নামলাম। মানিব্যাগ থেকে এক হাজার টাকার একটা নোট বের করে তাঁর হাতে দিয়ে বললাম, ‘একটা শার্ট কিনে নিয়েন চাচা।’
উনি বললেন, ‘এত টাকা দিবেন বাজান?’
তারপর তাঁর ঘেমে যাওয়া হাতটা আমার মাথায় বুলিয়ে দিতে গিয়েও থেমে গেলেন। যদি আমি কিছু মনে করি হয়তো এই ভয়ে। আমি তাঁর হাতটা টেনে নিয়ে আমার মাথায় রাখলাম।
উনি বললেন, ‘কোনো কষ্টে আছেন, বাজান?’
নিজে প্রচণ্ড শারীরিক কষ্টের মধ্যে থেকেও উনি আমার কষ্টের কথা ভাবছেন। একজন বাবার পক্ষেই এমনটা সম্ভব। বাবার কথা মনে পড়ল আমার। আমি কোনোরকমে অশ্রু সংবরণ করে চলে এলাম সেখান থেকে।
ওনার কথাটা বারবার কানে বেজে উঠছিল, ‘কোনো কষ্টে আছেন, বাজান?’
আমার মনে হচ্ছিল চিৎকার করে বলে উঠি, ‘কষ্টে আছি আমি। বড় কষ্টে আছি। আমার বাবা নেই। মাথায় হাত বুলিয়ে দেওয়ার মতো কোনো পুরুষমানুষ নেই এ পৃথিবীতে!’
(প্রথম প্রকাশ- পাক্ষিক অনন্যা, ১৮ জুন ২০২২)