একজন লেখকের মৃত্যু
(১)
যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, চলে এসো, এক বরষায়।— গানের কথাগুলো ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হতে থাকে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে। যতদূর মনে পড়ে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ইমারজেন্সি ওয়ার্ড এ তিনি শুয়েছিলেন। পরিচিত কিছু মুখ তাঁকে ঘিরে রেখেছিল। এই মুহূর্তে তাদেরকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে। তিনি চোখ খোলার চেষ্টা করেন। কিন্তু কোন এক অদৃশ্য শক্তি যেন বাধা দেয়। তাঁর আর চোখ খুলতে ইচ্ছে করেনা। চুয়ান্ন বছরের জীবনে এ রকম কখনো হয়নি আর। হাত-পা নাড়ানো যায় না। কিছু শোনা যায় না। আবার চোখ খুলতেও মন চায় না। কী অদ্ভুত পরিস্থিতি!
(২) প্রকাশকের কথা
ওসমান সাহেবের জ্ঞান এখনও ফেরেনি। ডাক্তার বলেছেন আরও দু’দিন লাগবে। তারপর হয়ত কিছু বলা যেতে পারে। তবে বিভিন্ন রকমের জটিলতা আছে। খুব বেশি আশা না করাই ভালো। ওসমান সাহেবের সাথে আমার প্রথম দেখা হয়েছিল বছর তিনেক আগে। নতুন লেখক ও একজন প্রকাশকের গতানুগতিক আলাপচারিতা। তারপরও প্রথম সাক্ষাতের কথা আমার স্পষ্ট মনে আছে। আমি অফিসে বসেছিলাম। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছিল। ভিজে চুপসে যাওয়া পাঞ্জাবী পরা একজন বয়স্ক লোক আমার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ালেন। পলিথিনে মোড়া একটা প্যাকেট আমার হাতে দিলেন। তারপর বললেন, ‘অনেকগুলো উপন্যাস লিখেছি। প্রকাশের কথা কখনও ভাবিনি। এখানে আমার সেরা তিনটি উপন্যাস আছে। শুনেছি আপনি অনেক বড় প্রকাশক। আমার স্ত্রীর চিকিৎসার জন্য দুই লাখ টাকা প্রয়োজন। সাতদিনের মধ্যে টাকাগুলো লাগবে। এই কাগজে আমার নাম-ঠিকানা লেখা আছে। আপনার একটা কার্ড দিন আমাকে। আমি আর সময় দিতে পারব না। আমাকে হাসপাতালে যেতে হবে।’
আমি অবাক হয়ে চেয়েছিলাম লোকটার দিকে। তাঁর কথাগুলো যেন সম্মোহিতের মত শুনছিলাম। জীর্ণ বেশভূষাতেও একটা বিশাল ব্যক্তিত্বের ছোপ। বৃষ্টির ছোঁয়া তাঁর শান্ত-সুন্দর অবয়বকে আরও স্নিগ্ধ করেছে। আমি কিছু বলার আগেই তিনি বেরিয়ে গেলেন। মানুষ এত সহজভাবে ভাবতে পারে ! তাঁর কথায় করুণা প্রার্থনার লেশমাত্র ছিল না। আমার মনে হলো তিনি যেন অধিকার নিয়ে কথা বলছিলেন। চিরকুটটা হাতে নিলাম। মেয়েলি হাতে লেখা – ওসমান গণি, ৫২৭/১৫, পূর্ব শেওড়াপাড়া, ঢাকা। উপন্যাসের পাণ্ডুলিপিগুলোও একই হাতে লেখা। বিভিন্ন ব্যস্ততায় সেগুলো আর দেখা হয়নি। ওসমান সাহেবের কথাও বেমালুম ভুলে গিয়েছিলাম।
পরের বছর একুশের বইমেলায় ঘটল অভাবনীয় এক ঘটনা। এ সময়ের সেরা লেখক মীর্জা মাহমুদ এর পাঁচটি বই প্রকাশ করেছিলাম আমি। ফেব্রুয়ারীর দ্বিতীয় সপ্তাহেই বইগুলো মেলায় আসে। তাঁর উপন্যাস ‘যবনিকা’ তখন বেস্টসেলার এর তালিকায়। মীর্জা মাহমুদ সাহেব আমাকে বাসায় ডেকে পাঠালেন। আমি ভাবলাম, হয়ত আরেকটা লেখা পাবো। তাই দেরী না করে সাথে সাথে বাসায় চলে গেলাম। উনি আমার অপেক্ষাতেই বসেছিলেন। হাতে ‘যবনিকা’। মুখটা গম্ভীর। তাঁর এরকম অভিব্যক্তির সাথে আমি একদম অপরিচিত। তিনি বললেন, ‘ফরিদ সাহেব, আমি ব্যস্ততার কারণে পান্ডুলিপি দেয়ার পর আর খোঁজ নিতে পারিনি। আই অ্যাম সরি ফর দ্যাট। কিন্তু তাই বলে আপনি আরেকজনের লেখা আমার নামে চালিয়ে দেবেন। দিস ইজ টোটালি আনইথিক্যাল। আই অ্যাম রিয়েলি শকড। ‘যবনিকা’ আমার লেখা না। পাণ্ডুলিপিটা কাউকে আনতে বলেন।’
আমি আকাশ থেকে পড়লাম। আমার আঠার বছরের প্রকাশনা জীবনে এরকম ঘটনা কখনও ঘটেনি আগে। আমি ফোন করে উপন্যাসটির পাণ্ডুলিপি আনতে বললাম। আসলে আমিও তদারকি করতে পারিনি। কিন্তু তাই বলে এরকম একটা ভুল! অনেক ভেবেও কোন কিছু উদ্ধার করতে পারলাম না। পাণ্ডুলিপি নিয়ে আসতেই ছেলেটার হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নিলাম। হাতের লেখা দেখেই বুঝতে পারলাম লেখাটা ওসমান গণি সাহেবের। সব ঘটনা খুলে বললাম মাহমুদ সাহেবকে। তিনি বললেন, ‘বাকি দুই উপন্যাস ছাপানোর ব্যবস্থা করেন। আমি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে বলছি। আর ‘যবনিকা’র টাকাটা আমি গণি সাহেবকে দিতে চাই। আপনি যোগাযোগ করেন।’
আমি মহৎ হৃদয় মানুষটার দিকে চেয়ে থাকলাম কিছুক্ষণ। তারপর ফিরে এলাম অফিসে। সারা অফিস তন্নতন্ন করে খুঁজেও পেলাম না গণি সাহেবের ঠিকানা সম্বলিত চিরকুটটা। তারপর অনেকভাবে চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাঁর সন্ধান মেলেনি।
প্রায় পাঁচ মাস পরের কথা। আমি অফিসে বসেছিলাম। একটা মেয়ে এসে সালাম দিল। বয়স বিশ/বাইশ হবে। ওর নাম মিতা। গণি সাহেবের মেয়ে। ওর কাছেই জানলাম গণি সাহেব ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। আমি দেরী না করে মিতাকে নিয়ে রওনা দিলাম। গাড়িতে বসে মেয়েটা একদম চুপচাপ বসেছিল। আমি জানতে চাইলাম, তোমার মা কেমন আছে? কিছুক্ষণ পর সে বলল, ‘মা নেই। এক বছর আগে মারা গেছেন।’
নিজেকে অপরাধী মনে হচ্ছিল আমার। মিতা কাঁদছে। এতটুকু একটা মেয়ে। আর কত সইবে? আমি মাহমুদ সাহেবকে ফোন দিলাম। উনি ওসমান সাহেবকে অন্য কোনো হাসপাতালে নিতে বললেন। আমি তাই করলাম। এখানেও একদিন পেরিয়ে গেছে। এখনও জ্ঞান ফেরেনি ওসমান সাহেবের। আমরা সবাই অপেক্ষায় আছি।
(৩) মিতার কথা
মা মারা যাওয়ার পর থেকে বাবাকে ভীষণ অসহায় মনে হচ্ছে। লেখালেখি প্রায় বন্ধ। একদিন আমাকে ডেকে বলল, ‘আমি আর পারছি না রে মা। তোর মা স্কুল থেকে যা পেত আর আমার টিউশনিতে মোটামুটি চলে যেত। আমাদের মনে হয় গ্রামে ফিরে যেতে হবে। আর তোর পড়াশুনাও…’
কথাটা শেষ করতে পারল না। শিশুদের মত চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। বাবার বিশ্বাস ছিল তার লেখা খুব উঁচুমানের। এ লেখাগুলোই একদিন তাকে সচ্ছলতা এনে দেবে। টিউশনির ফাঁকে ফাঁকে একটাই কাজ। লেখা আর লেখা। আমার দায়িত্ব ছিল খসড়া লেখাগুলোকে সুন্দর করে লিখে রাখা। কাজটাতে আমিও আনন্দ পেতাম। তাইতো প্রতিটি লেখা, প্রতিটি চরিত্র আমার প্রাণের সাথে মিশে আছে।
আমরা পরের মাসে গ্রামে ফিরে এলাম। বড় চাচার বাড়িতে। বাবা আবার লেখায় মন দিল। বড় চাচা আমার বিয়ের চেষ্টা করছিল। সময় পার হয়ে যাচ্ছিল কোনোরকমে। কিন্তু আবার পাল্টে গেল সবকিছু। বাবা হাট থেকে ফেরার পথে অ্যাকসিডেন্ট করল। থানা সদর হাসপাতালে নেওয়া হল। সেখান থেকে ঢাকায়। অ্যাকসিডেনটের পর বাবার মানিব্যাগে একটা কার্ড পেয়েছিলাম। বিন্দু প্রকাশ নামের এক প্রকাশনা সংস্থার কার্ড। ভাবলাম বাবার সাথে পরিচয় থাকতে পারে। মেডিকেলে চাচাকে রেখে আমি চলে গেলাম বিন্দু প্রকাশ এর অফিসে। পরিচয় হল ফরিদ সাহেবের সাথে। বাবার নাম বলতেই চিনতে পারলেন। আমরা বাবাকে নিয়ে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভর্তি করলাম। ডাক্তার আসছে, যাচ্ছে। বাবার জ্ঞান ফিরছে না।
(৪)
ওসমান সাহেব চোখ মেললেন। মিতা পাশে বসে আছে। কাঁদছে। ভাবলেন, তিনি মারা গেলে এই মেয়েটা বাঁচবে কী নিয়ে! কিছু বলার চেষ্টা করলেন। ঠোঁট দুটি একটু নড়ে উঠল। কিন্তু কোন শব্দ বের হল না। চোখের জল কোন বাধাই মানছে না। অবিরত বয়ে চলেছে। মীর্জা মাহমুদ সাহেব একটা বই তাঁর চোখের সামনে ধরলেন। প্রচ্ছদে শিল্পীর তুলিতে আঁকা ছাদের রেলিং এ ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো বৃষ্টিস্নাত এক নারীর ঝাপসা অবয়ব। মিশে আছে দিগন্তের বিশালতায়। ‘বাদল দিনের শেষ কদম ফুল’ নামটাও যেন বৃষ্টিতে ধুয়ে যাওয়ার অপেক্ষায়। নীচে ধবধবে সাদা ‘ওসমান গণি’। ওসমান সাহেবের মুখে একটা চঞ্চলতার ভাব দেখা দিল। সমস্ত প্রাণশক্তি হাতে এনে ছুঁয়ে দিলেন বইটির প্রচ্ছদ। তারপর একসময় হাতটা নিথর হয়ে গেল। মিতার মোবাইলে তখনও বেজে চলেছে বাবার প্রিয় গান –– যদি মন কাঁদে, তুমি চলে এসো, চলে এসো, এক বরষায়।
১৯ জুলাই ২০২২