অপেক্ষা
আমি অপেক্ষায় আছি নিজেকে ফিরে পাওয়ার। কিছুক্ষণ আগে কংক্রিটের এই বেঞ্চের উপর আমি নিজেকে হারিয়ে ফেলেছি। আমার সামনের লেক এখনও সাদা কুয়াশায় ঢাকা। তার মানে খুব সম্ভবত আমি সকালে হাঁটতে এসেছিলাম এই পার্কে। নিজে এসেছি, নাকি কারও সাথে এসেছি, নাকি কেউ বাসা থেকে এখানে দিয়ে গেছে তাও মনে নেই। ডায়াবেটিস বাড়ার সাথে সাথে আমার ভুলে যাওয়ার রোগ দিন দিন প্রকট আকার ধারণ করছে।
এখন দুইটা জিনিস মনে করা জরুরি।
এক, আমি কে?
দুই, আমার বাসা কোথায়?
হঠাৎ মনে হলো প্রথমটা না হলেও চলবে। আপাতত দ্বিতীয়টা হলেও চলবে। বাসায় ফিরে গেলেই হয়তো আমি কে তা বুঝতে পারব।
পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে অনেকেই। সবাই অপরিচিত। এদের মধ্যে কেউ আমাকে চিনলে অবশ্যই সালাম দিত। পরিচিত ছাড়া কেউ কাউকে আর সালাম দেয় না। মনে পড়ে গেল কয়েকদিন আগের কথা। বাজারে গিয়ে একই অবস্থা হয়েছিল আমার। মসজিদের পাশের ফুটপাতে বসেছিলাম অনেকক্ষণ। পরে একজন আমাকে সালাম দেওয়ার পর তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, আমাকে আপনি চেনেন?
তিনি বললেন, না। কেন বলুন তো?
আমি তাকে বললাম, আমি বাসায় যাব। কিন্তু ঠিকানা ভুলে গেছি।
লোকটা আমার হাত ধরে নিয়ে গেল মসজিদের ভিতর। মুয়াজ্জিনকে ডেকে তুললেন। মুয়াজ্জিন সাহেব ঘুমজড়ানো চোখে মাইকে ঘোষণা দিলেন,
‘একটি বিশেষ ঘোষণা। আনুমানিক সত্তর বছর বয়সী একজন বৃদ্ধ পাওয়া গিয়েছে। ওনার পরনে আছে ধুসর রঙের পাঞ্জাবি। উনি নিজের নাম ও বাসার ঠিকানা বলতে পারেন না। অনুগ্রহ করে বাজার মসজিদ হতে তাঁকে নিয়ে যান।’
কিছুক্ষণ পরেই বড় ছেলে এসে আমাকে মসজিদ থেকে বাসায় নিয়ে গিয়েছিল। আমার সামনে না হলেও আমার আড়ালে এ বিষয়টি নিয়ে অনেক হাসাহাসি হতো। ঐ রকম ঘটনা আরও একবার ঘটুক আমি তা চাইনা।
স্মৃতি না ফেরা পর্যন্ত আমি এখানে অপেক্ষা করব।
হঠাৎ মনে হলো আমার বড় নাতনির কথা। প্রথমবার হারিয়ে যাওয়ার পর তার বুদ্ধিতে আমাকে একটা মোবাইল ফোন দেওয়া হয়েছিল। ঐ ফোনের যে কোন একটা বোতামে চাপ দিয়ে ধরে থাকলেই আমার মেয়ে বা ছেলে বা নাতি নাতনির যে কোন একজনের কাছে কল চলে যাবে।
পায়জামা ও পাঞ্জাবির চার পকেট হাতড়ে মোবাইল ফোনটা বের করলাম। হাতে নিতেই একটু অন্যরকম মনে হলো। তারপরও একটা বোতামে চেপে ধরে রেখে কানের কাছে ধরলাম। কোনো শব্দ পেলাম না। এভাবে একে একে প্রত্যেকটা বোতাম চেপে ধরে কানের কাছে নিলাম। কোন সাড়া শব্দ পেলাম না। মনে হয় চার্জ নাই। তারপরই মনে হলো, আরে এটার তো কোন পর্দা নাই, যেখানে নম্বর লিখলে দেখা যায়। আবার আকারেও একটু বড়। এখানে বোতামের সংখ্যাও অনেক বেশি। মোটামুটি নিশ্চিত হ্লাম এটা মোবাইল ফোন নয়। পকেটে রাখতে গিয়েই মনে পড়ল বাসা থেকে বের হওয়ার আগে টিভি দেখেছিলাম কিছুক্ষণ। হয়তো মোবাইল ফোনের বদলে টিভির রিমোট নিয়ে চলে এসেছি। হতে পারে। আমি নিশ্চিত নই।
আজকের দিনটাই শুরু হয়েছিল অঘটন দিয়ে। ফজরের নামায পড়ার পর ডাইনিং টেবিলে রাখা বিস্কিটের কন্টেইনার থেকে বেশ কয়েকটা বিস্কিট খাওয়ার পর মনে হয়েছিল বিস্কিটের স্বাদ একটু অন্যরকম। মিষ্টি মিষ্টি। পরে বুঝেছিলাম ভুল কন্টেইনার থেকে বিস্কিট খেয়েছি। আহ! মিষ্টিটা এখনও মুখে লেগে আছে। কী জানি, হয়তো ইচ্ছা করেই জেনে বুঝে মিষ্টি বিস্কিট খেয়েছিলাম। আমি নিশ্চিত নই।
বাসা থেকে বের হয়ে যখন লিফটে উঠেছিলাম, তখনও একটা সমস্যা হয়েছিল। যদিও বাসা থেকে নিচে আসার উপায় আমার একদম মুখস্থ। বাসা থেকে বের হয়ে লিফটের ডাউন-অ্যারো বাটন চাপ দিতে হবে, তারপর লিফটে উঠে আমার প্রিয় নম্বর ৭ এ চাপ দিয়ে নিচে নামতে হবে। কিন্তু আজ অনেকবার ৭ এ চাপ দিয়ে লিফটকে নিচে নামাতে পারিনি। লিফট যেখানে ছিল সেখান থেকে এক চুলও নড়েনি। পরে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এসেছি।
আমার হাসি পাচ্ছে। কারণ আমার এইমাত্র মনে পড়ল ৭ নম্বর বাটন হলো বাসায় ফেরার। আর বাসা থেকে নামার বাটনে কোন সংখ্যা নেই, ইংরেজি বর্ণ আছে। কিন্তু কোন বর্ণ বা কয়টা বর্ণ তা আমি নিশ্চিত নই।
‘পেপার, পেপার, আজকের পেপার।’
মনে হলো, পেপার পড়ে কিছুটা সময় কাটানো যায়। পেপার পড়তে পড়তে হয়তো বাসার ঠিকানা মনে পড়ে যাবে। ছেলেটাকে কাছে ডাকলাম।
‘কোন পেপার নিবেন, স্যার?’
আসলেই তো! কোন পেপার পড়ব? কিছুক্ষণ ধরে স্মৃতি হাতড়ে কোন পেপারের নাম খুঁজে না পেয়ে তাকে বললাম, দাও, একটা দিলেই হলো।
পেপার হাতে নিয়ে পায়জামা ও পাঞ্জাবির চার পকেট হাতড়ে তার হাতে একটা নোট দিলাম। কত টাকার নোট আমার মনে পড়ছে না। তবে ছেলেটার মুখের ভাব দেখে মনে হল হয় পেপারের যা দাম তার চেয়ে অনেক কম হয়ে গেছে অথবা অনেক বেশি হয়ে গেছে।
সে বলল, আমার কাছে ভাংতি নাই।
আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। তারপরে মনে হলো মাথাটাকে আর কষ্ট দেওয়ার প্রয়োজন নাই। বললাম, ঠিক আছে। তুমি যাও।
এবারে ছেলেটার মুখের ভাব দেখে বুঝলাম, অনেক বেশি দিয়ে ফেলেছি। যা হয় হয়েছে। আমি চাচ্ছিনা এই ছোট্ট ছেলেটাও জানুক যে, আমি এখন টাকার নোটগুলো আলাদা করে চিনতে পারছি না।
সে চলে যাওয়ার পর পেপারটা মেলে ধরলাম। ছবিগুলোর বিষয়বস্তু আমার কাছে স্পষ্ট হলেও আমার পরিচিত কোন বর্ণ খুঁজে না পেয়ে হতাশ হলাম। পৃষ্ঠা উল্টালাম। কোন পরিবর্তন নেই। কিছুক্ষণ চোখ বন্ধ করে থাকলাম। তারপর আবার চোখ মেলে তাকালাম। আমার পরিচিত কোন বর্ণ নেই। সারা পেপার জুড়ে ছবি আর বিভিন্ন ধরণের অদ্ভুত চিহ্ন। পেপারটা ভাঁজ করে রেখে দিলাম। মনে পড়লো অনেকদিন আগে থেকেই আমি পড়তে পারিনা, লিখতে পারিনা। চাকুরীজীবনের লক্ষ লক্ষ বার দেওয়া চিরপরিচিত স্বাক্ষরও এখন আর দিতে পারিনা। টিপসই দিয়ে পেনশনের টাকা উঠাতে হয়।
কুয়াশা কেটে গেছে। মিষ্টি রোদ উঠেছে। কত বাজে? হাতের ঘড়িটার দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে চোখ ঝাপসা হয়ে এল। বড় মেয়েটা উপহার দিয়েছিল। অনেক দামি ঘড়ি। সময় বুঝতে না পারলে দাম দিয়ে কী আসে যায়। মেয়ের দেয়া উপহার। একবার ঘড়িটায় হাত বুলালাম। দেখলাম, একটা কাঁটা নড়ছে। কিন্তু কোন কাঁটায় কী হয় তা উদ্ধার করতে পারলাম না।
ক্ষুধা লেগেছে। কংক্রিটের বেঞ্চে বসে থাকতে আর ভালো লাগছে না। উঠে একটু হাঁটতে চাইলাম। শক্তি পেলাম না। দুই পাশ থেকে কারা যেন দুই হাত জাপটে ধরে বসে আছে। মনে পড়ে উঠানের বারান্দায় রাখা কাঠের বেঞ্চে দাদা আর বাবা আমাকে দুই পাশ থেকে জাপটে ধরে বিসিজি টিকা দিয়েছিল। প্রাইমারি স্কুলে পড়ার সময় ঐ টিকা আমাকে স্কুলে দিতে পারেনি। টিকা দেওয়ার সংবাদ আগেই পেয়ে যেতাম আর ক্লাসরুমের ভাঙ্গা জানালা দিয়ে দৌড়। বাড়িতে যেদিন ডাক্তার এসেছিল সেদিনও সংবাদ পেয়েছিলাম। দোতলা মাটির বাড়ির টিনের চালার নিচে লুকিয়ে ছিলাম কয়েক ঘণ্টা। তারপর যখন নিচে এলাম দেখলাম মার মুখ ভাবলেশহীন।
জিজ্ঞাসা করলাম, মা, টিকার ডাক্তার কি চলে গেছে?
মা বললেন, জানি না।
তারপর বাড়ি থেকে বাইরের উঠানে যাওয়ার দরজার বাইরে পা রাখতেই দুইপাশ থেকে দাদা আর বাবা জাপটে ধরলেন। ডাক্তারকে ডেকে আনা হলো। তারপর সেই ব্যথা। আজও আছে। হাত বুলিয়ে দেখলাম, হ্যাঁ এখনও ব্যথা আছে। একটু পরেই মনে হলো, কয়েকদিন আগেই করোনার টিকা নিয়েছি। আমার এখন বয়স কত? দাদা, দাদী, বাবা, মা, তাঁরা কোথায়? এইতো সেদিন দাদা বাজার থেকে সন্দেশ এনে আমাকে ডেকে ডেকে হয়রান হয়ে গেলেন। তারপর দাদির হাতে দিয়ে বললেন, আমার ভাইকে খাইয়ে দাও। দাদির কোলে বসে সন্দেশ খেলাম। আহ! কী মিষ্টি! এখনো স্বাদ লেগে আছে মুখে।
আর মা? কদিন আগেই তো মার হাত ধরে হাঁটতে শিখলাম। বাবার হাত ধরে স্কুলে গেলাম।
মা, তুমি কোথায়? বাবা তুমি কোথায়? আমি কাঁদতে শুরু করি।
তোমরা যে কোন একজন এসে আমাকে নিয়ে যাও। মা, আমি হারিয়ে গেছি মা। তোমার ছেলেকে নিয়ে যাও মা। বারান্দার কাঠের বেঞ্চটাতে শুয়ে আছি আমি। আমাকে ঘরে নিয়ে যাও মা। আমার হাত-পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তোমার বুকে জায়গা দাও মা। মা! আমি কাঠের বেঞ্চের উপর পড়ে আছি তোমার অপেক্ষায়।
(প্রথম প্রকাশ- দৈনিক যুগান্তর, ২২ এপ্রিল ২০২২)