ফেরা
২০৫০ সাল।
ক্যাপসুলের মতো ছোট কাচের ঘরের মধ্যে ঘুমিয়ে আছে মৌ। পৃথিবীর সবাই মাটির নিচে এরকম ক্যাপসুলে সারা দিন কাটায়।
২০৩০ সালের প্রথম দিকে সূর্যের তাপ হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে। ২০৪৮ সালে তা এমন অবস্থায় পৌঁছায় যে দিনের বেলা পৃথিবীপৃষ্ঠে অবস্থান করা মানুষের পক্ষে একদম অসম্ভব হয়ে পড়ে। অসংখ্য মানুষ মারা যায়। অনেকেই অন্য গ্রহে পাড়ি জমায়। যারা বেঁচেছিল তারা মাটির নিচে ক্যাপসুলে বসবাস শুরু করে। সূর্যোদয়ের কয়েক মিনিট আগে সবাই যার যার ক্যাপসুলে ঢুকে পড়ে। তারপর সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিরবিচ্ছিন্ন প্রগাঢ় ঘুম। সূর্যাস্ত হওয়ার সাথে সাথে তাদের ঘুম ভেঙে যায়। তারপর ক্যাপসুল থেকে বেরিয়ে পড়ে যে যার কাজে।
সূর্যাস্তের আধা ঘণ্টা বাকি আছে। মৌ এখনও গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ তীব্র ঝাঁকুনি খায় সে। তারপর থরথর করে কাঁপতে থাকে। এভাবে মিনিট দশেক চলার পর তার ঘুম ভেঙে যায়। নির্ধারিত সময়ের বিশ মিনিট আগে ঘুম ভেঙে যাওয়ায় ভীষণ বিরক্ত হয় মৌ। ক্যাপসুলের কন্ট্রোল প্যানেলে ঢুকেই বুঝতে পারে কেউ তার গোপন পাসওয়ার্ড ব্রেক করে সূর্যাস্তের সময় পাল্টে দিয়েছে। কে করতে পারে এমন কাজ? ভাবতেই মনে পড়ে জিসিয়া আর মিতুলের কথা। মঙ্গল গ্রহে থাকে ওরা। আজই ওদের পৃথিবীতে আসার কথা। মিতুল আবার পাসওয়ার্ড ব্রেক করার ওস্তাদ। নিশ্চয় সে তার ক্যাপসুলের টাইমটেবিল গোলমাল করে দিয়েছে।
দশ বছর পর জিসিয়া আর মিতুল পৃথিবীতে যাচ্ছে। তাদের চোখেমুখে পৃথিবীতে ফেরার আনন্দ। সবচেয়ে ভালো লাগছে মৌ এর কথা ভেবে। দশ বছর ওরা ওদের প্রিয় বান্ধবীকে দেখেনি। পাশাপাশি দুটো স্পেসশিপে ওরা ছুটে চলেছে পৃথিবীর দিকে। আচমকা এক উল্কাপিণ্ড ছুটে আসে ওদের দিকে। মিতুল তার ক্যাপসুলটিকে সরিয়ে নিতে সক্ষম হলেও জিসিয়া পারে না। উল্কার আঘাতে বিস্ফোরিত হয় তার ক্যাপসুল। মিতুল শুধু চেয়ে চেয়ে দেখে তার বান্ধবীর করুণ মৃত্যু।
বিষণ্ণ মনে মিতুল পৃথিবীর কাছাকাছি পৌঁছে। মৌ এর ক্যাপসুলের কন্ট্রোল প্যানেলে ঢুকে তার ঘুম ভেঙে দেয়। দুঃসংবাদটি দূর থেকেই জানাতে চায়। কিন্তু মন সায় দেয় না। ক্যাপসুল থেকে নেমে দুই বান্ধবী একে অপরকে জড়িয়ে ধরে। দুজনের চোখেই পানি। কিছুক্ষণ পর মৌ জিজ্ঞেস করে জিসিয়ার কথা। মিতুল সব ঘটনা খুলে বলে তাকে। আরো বলে, জিসিয়াকে ছাড়া কিছুতেই সে মঙ্গল গ্রহে ফিরতে পারবে না।
মৌ বলে, পৃথিবীতে একটা ক্লোনিং মেশিন আছে। এই মেশিনের সাহায্যে জিসিয়াকে নতুন করে সৃষ্টি করা সম্ভব। কিন্তু সে মেশিন আছে নিউইয়র্কের এক ভূগর্ভস্থ মিউজিয়ামে। সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা এতটাই নিশ্ছিদ্র যে মেশিনটা বের করে আনার কথা কল্পনাও করা যায় না।
মিতুল বলে, এরকম মেশিন আরও থাকা উচিত ছিল। তাহলে পৃথিবীর মানুষ অনেক সুবিধা পেত।
মৌ বলে, যন্ত্র অনেকগুলোই ছিল। কিন্তু ভালো কাজের চেয়ে খারাপ কাজই বেশি হওয়ার কারণে মেশিনগুলো ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। শুধু একটা মিউজিয়ামে রাখা হয়েছে।
মিতুল ওর ক্যাপসুলে ঢুকে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যে স্ক্রিনে ভেসে ওঠে ক্লোনিং মেশিনের ছবি। মিতুল এখান থেকেই মেশিনটা চালাতে থাকে। মৌ অবাক হয়ে যায়। মিতুল বলে, আমি এখান থেকেই জিসিয়াকে তৈরি করতে পারব। কিন্তু তোর সাহায্য দরকার। তুই শুধু মনে মনে জিসিয়ার অবয়ব তৈরি করবি। মেশিনটা তোকে অনুসরণ করে তা মানুষে রূপ দেবে।
মিতুলের কথামতো বসে পড়ল মৌ। ওর মাথার চারপাশে কয়েকটা ছোট ছোট যন্ত্র লাগিয়ে দিল মিতুল। তারপর শুরু হলো ক্লোনিং এর কাজ। মেশিনটাকে বেশ সফলভাবে নিয়ন্ত্রণ করল সে। একসময় তৈরি হলো নতুন এক জিসিয়া। নতুন জিসিয়াকে দেখে মিতুল আর মৌ দুজনই হাসতে লাগল। মৌ যে ইমেজ মেশিনকে দিয়েছে সেটা দশ বছর আগের ছোট্ট জিসিয়ার। মেশিন সেরকমই এক জিসিয়াকে তৈরি করেছে।
জিসিয়া ওদের বলে, আন্টি, আমি বাড়ি যাব।
মৌ হাসিমুখে বলে, আচ্ছা তাই হবে।
(প্রথম প্রকাশ- কম্পিউটার টাইমস, ফেব্রুয়ারি ২০০২, দ্বিতীয় প্রকাশ – ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪) প্রচ্ছদ- কমল ইউসুফ