জীবনের হিসাবনিকাশ
আফতাব আহমেদের হিসাবনিকাশ বোঝার সাধ্য তার পরিবারের কারোরই হয়নি। নিজে যখন চাকুরি করতেন, তখন তার আয়-ব্যয়ের হিসাব চাওয়ার সাহস কেউ করেনি। এমনকি চাকুরি থেকে অবসর নেওয়ার পর ছেলেদের দেওয়া মাসিক বরাদ্দের একটা বিশাল অংশ কোথায় যে হাওয়া হয়ে যেত, তারও কোনো হদিস পাওয়া যেত না। স্ত্রীর পুরো সন্দেহ ছিল আলাদা আরেকটা সংসার থাকা নিয়ে।
আফতাব আহমেদের আরেকটা আলাদা সংসারের বিষয়ে খোঁজ পাওয়া গেল তার মৃত্যুর মাসখানেক পরে। অচেনা এক নম্বর থেকে ফোন এল বড় ছেলে আশফাক আহমেদের কাছে। যিনি ফোন করেছেন তিনি জানালেন যে, আফতাব আহমেদের রেখে যাওয়া মেয়েদের নিয়ে ভীষণ বিপদে পড়েছেন। এখন তার ছেলেরাই ভদ্রলোককে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করতে পারেন। কিন্তু উনি ফোনে বিস্তারিত বলতে নারাজ। মূল ঘটনা জানতে হলে তাকে ভদ্রলোকের দেওয়া ঠিকানায় সশরীরে যেতে হবে।
কৌতূহলের বশেই রাজি হলো আশফাক। ভদ্রলোকের দেওয়া ঠিকানায় যথাসময়ে হাজির হলো। টিনশেডের একটা বাড়ি। কলিং বেল দিতেই একজন ভদ্রলোক দরজা খুলে বাসার ভেতরে নিয়ে গেল। ছোট্ট একটা বসার ঘরে একটা প্লাস্টিকের টি-টেবিল ঘিরে কয়েকটা চেয়ার রাখা। একটু ইতস্তত করলেও একটা চেয়ারে বসে পড়লো আশফাক। ভদ্রলোক বললেন, ‘আমি এই ব্লকের মসজিদের মুয়াজ্জিন। আমার কোনো ছেলেমেয়ে নাই।’
তার কথা শেষ না হতেই ঐ ঘরে একে একে দশটা মেয়ে ঢুকে পড়ে। বয়স খুব বেশি হলে পাঁচ-ছয় বছর হবে। একই পোশাক সবার।
ভদ্রলোক বললেন, ‘এরাই আপনার বাবার মেয়েরা। পাশের ব্লকে আমার একটা এতিমখানা আছে। আপনার বাবা সেখানে প্রতিমাসেই টাকা দিতেন। বছর তিনেক আগে আমাকে বললেন তিনি কয়েকজন মেয়েকে একটু আলাদা করে বড় করতে চান। নিজের মেয়েদের মতো। আমাকে বললেন, তিনিই সব খরচ দেবেন যদি আমার আপত্তি না থাকে । নিজের সন্তান না থাকায় আমারও আপত্তি ছিল না। পরে এই চার রুমের বাসা নিই। দুই রুমে ওরা থাকে। আপনার বাবা সকাল-বিকাল ওদের সাথে সময় কাটাতেন। উনি আমাকে মাসে দশ হাজার টাকা দিতেন। সে টাকা প্রায় শেষের পথে। কী করব বুঝতে পারছি না।’
আশফাকের চোখে পানি এসে গেছে। বাবাকে কতই না ভুল বুঝেছে তারা। আশফাকের মনে পড়লো বাবা ওদের জন্মদিন পালনের কথা শুনতেই ক্ষেপে যেতেন। বলতেন, ‘যে টাকা তোরা এক ঘণ্টায় খরচ করবি, সেই টাকাই কয়েকজন মানুষের মাসের খরচ মিটে যায়।’
গতকালও বাসায় একটা কেক নিয়েছে আশফাক। প্রায় দুই হাজার টাকা। মানে বাবার দুই মেয়ের এক মাসের খরচ। যা তারা পাঁচ মিনিটে শেষ করেছে। আশফাক মেয়েগুলোকে কাছে নিয়ে আদর করে। পরে ভদ্রলোকের কাছ থেকে কিছু সময়ের জন্য বিদায় নিয়ে বাইরে আসে। কাছের একটা এটিএম বুথ থেকে টাকা তুলে ভদ্রলোকের কাছে দিয়ে আসে।
বাসায় ফিরতে ফিরতে মনে মনে ভাবে, ‘মাকে নিয়ে আসতে হবে একদিন। জীবনের হিসাবনিকাশ ঠিকই বুঝেছেন বাবা। আমরাই বুঝতে পারিনি।’
০৮ জুলাই ২০২২